আমি বলবো, এ ব্যাড ডে ফর মুসলিমস
দিনবদল ডেক্স: আমি বলবো, এ ব্যাড ডে ফর মুসলিমস। (ডনাল্ড ট্রাম্পের) শপথ অনুষ্ঠানে তাদেরকে শুধু যেভাবে উচ্চারণ করা হলো তা পুরো হলিউড ধাঁচের এবং খুবই বিপজ্জনক। ‘কট্টর ইসলামপন্থি জঙ্গিবাদকে দুনিয়ার বুক থেকে আমরা পুরোপুরি মুছে দেবো’।
এটাই ছিল তার দেশবাসীকে দেয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রস্তাবের মধ্যে সবচেয়ে বড় হুমকি।
কেন এই সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটছে সেদিকে না তাকিয়ে তিনি জঙ্গিবাদকে নির্মূল করতে পারবেন না। কিন্তু সেদিকে দৃশ্যত কোনো আগ্রহ নেই তার। তাই এই সত্য থেকে অনেক দূরে সরে, তিনি ট্রাম্পবাদের পক্ষে ২০ মিনিটের বিজ্ঞাপন দিয়ে গেছেন। যেদিন থেকে আইএস শিরশ্ছেদ, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা উড়িয়ে দেয়া ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস গুঁড়িয়ে দিতে শুরু করলো, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত এটাই আইএস’র সদস্য সংগ্রহের সবচেয়ে দারুণ টোটকা হিসেবে কাজ করবে।
যখন দেশপ্রেমের জন্য আপনি আপনার হৃদয়কে উন্মুক্ত করবেন, সেখানে পক্ষপাতিত্বের কোনো স্থান নেনই। আমাদের স্বপ্নকে ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্য দেশ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে আমাদের সীমান্তকে রক্ষা করতে হবে। হ্যাঁ, এটাই সব এবং আরো কিছু।
অন্য দেশ দ্বারা কতটা ক্ষতি (র্যাভেজেস) হতে পারে, আমি বিস্মিত? এই টুইট-কাণ্ডে মধ্যপ্রাচ্য বেদনাহত হবে না, কারো নির্মূল করে দেয়ার আগ্রাসী নীতি থেকে নিরাপদ থাকবে। ট্রাম্প মৌলবাদী ইসলামিক জঙ্গিবাদকে পুরোপুরি নির্মূলের পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু কিভাবে এই উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে এ বিষয়ে তিনি সামান্যতম ইঙ্গিতও দেননি।
আমরা এ ব্যাপারে আন্দাজ করতে পারি। এর আগের প্রেসিডেন্টদের শপথ গ্রহণের বক্তব্যগুলোর দিকে একবার পেছন ফিরে তাকান। ১৯৫৭ সালে প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার মার্কিনিদের বলেছিলেন, অন্যদের চাওয়া-পাওয়া ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান দেখানোর মধ্য দিয়েই সব জাতির মধ্যে সমতা আনার চর্চা করা যেতে পারে। আবার জর্জ ডব্লিউ বুশের দিকে তাকান। তিনি যখন মনে করলেন তিনি হবেন যুক্তরাষ্ট্রে এ পর্যন্ত যত প্রেসিডেন্ট এসেছেন তার মধ্যে কঠিনতম। তিনি তার দ্বিতীয় শপথ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, আমাদের দেশের স্বাধীনতা (লিবার্টি) ক্রমাগতভাবে নির্ভর করছে অন্য দেশগুলোর স্বাধীনতার সফলতার ওপর। তিনি আরো বলেছিলেন, আমাদের এই বিশ্বে সবচেয়ে সেরা শান্তি হলো সারা বিশ্বে মুক্ত মতপ্রকাশের ধারণার বিস্তৃতি। এমনকি তিনি এক্ষেত্রে পবিত্র কোরআনের উল্লেখ করেছিলেন। সুচিন্তিত চিন্তা ভাবনার তুলনায় বিভক্তি সৃষ্টিকারী, যুদ্ধ-মনোভাবাপন্ন বার্তা পেয়েছেন বিশ্ববাসী ট্রাম্পের কাছ থেকে। এক্ষেত্রে বুশ ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন।
কেউই প্রত্যাশা করেননি যে, সদ্য বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মতো মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থ ও সম্মানের ভিত্তিতে সামনে নতুন পথে এগিয়ে যাওয়ার মতো উচ্চ-মার্কের পথ উদ্বোধনী ভাষণে দেখাবেন ট্রাম্প। ইসলামের পর ট্রাম্প তার দেশে ক্রাইম, গ্যাং ও মাদকের ইস্যুতে কথা বলেছেন। তিনি এটাকে ‘আমেরিকান কারনেজ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘অন্য দেশের অপতৎপরতা থেকে আমাদের সীমান্তকে রক্ষা করতে হবে’।
মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ আছে যেখানে আমাদের ওপর লাফালাফি করছে আইসিস, তারাও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা বিদেশি আগ্রাসন থেকে তাদের নিজেদের সীমান্তকে সুরক্ষা দিতে চায়। এক্ষেত্রে ইরাক ও আফগানিস্তানের কথা মাথায় রাখতে হবে। এসব স্থানে মনুষ্যবিহীন ড্রোন ও বিশেষ বাহিনীর অপারেশনে রক্তপাত হচ্ছে। সেইসব দেশে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের চালান দেয়া হচ্ছে, যে দেশগুলোর নাগরিকরা আইসিসের পতাকাতলে দলবদ্ধ হচ্ছে। সৌদি আরবের কথা বলতেই হয়, যদিও ট্রাম্প সেখানকার বিষয়ে নাক গলানোর কোনো আগ্রহ দেখাননি।
কিন্তু হয়তো ‘নিজেদের সীমান্ত সুরক্ষার চেয়ে অন্যদের সীমান্ত সুরক্ষার’ কথায় উপসাগরীয় একনায়করা শঙ্কিত হয়েছেন। ন্যাটোর চেয়ে এরাই কিন্তু ট্রাম্পের প্রকৃতিগত বন্ধু। ‘আজকের এই দিন থেকে সম্মুখপানে’ কথার সঙ্গে কেনেডির ‘লেট দ্য ওয়ার্ল্ড গো ফোর্থ’ কথা মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। মিলিয়ে দেখা যেতে পারে ‘এটা শুধুই প্রথমে আমেরিকা (আমেরিকা ফার্স্ট) নীতি হতে যাচ্ছে’।
ট্রাম্প বলতে পারতেন আমেরিকার দারিদ্র্য নিয়ে। অন্য তিনটি ‘শত্রু’ তার মুখ বন্ধ করে রাখেনি। তিনি কথা বলেছেন বিশ্বের ধনী মানুষদের জন্য।
বাইরের দুনিয়ার মানুষ এমন একজন প্রেসিডেন্ট চান না যিনি একজন মানুষের চাওয়ার বিষয়ে মনোযোগ দেন না, সেইসব মানুষ যারা কোণঠাসা হয়ে আছে বলে মনে করে। তাদেরকে কোণঠাসা করে রেখেছে অভিজাতরা ও কিছু উঁচু দরের মানুষ। যদিও আমরা জানি, ট্রাম্পের প্রস্তাবিত নতুন মন্ত্রিপরিষদে রয়েছেন এমন এলিট ও উঁচু দরের মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার পর উদ্বোধনী ভাষণে বাইরের দুনিয়ার অন্যদের সম্মান দেয়া, ধারালো কণ্ঠ, তুলনীয় করার ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা গেছে। আপনি যদি তার বক্তব্যগুলোকে উদ্ধৃত করেন, তাহলে দেখবেন প্রতিটিতে, প্রতিটিতে যথাযথ টুইট করা যায়। তার মতো ব্যক্তির কি এভাবে চিন্তা করার কথা? এটা যেন স্পোর্টসে বিজয়ী হওয়ার পর একটি বাণিজ্যিক বিরতি: ‘আমেরিকা উইল স্টার্ট উইনিং এগেইন’!
কোনো সন্দেহ নেই যে, তার বক্তব্যের পরের ২৪ ঘণ্টা মিডিয়ার সাংবাদিকরা সেরা শপথ গ্রহণ অনুসন্ধানে লড়াই করবেন। তিনি বলেছেন, আমরাই কাজটা শেষ করবো! তা এখান থেকে, ঠিক এই মুহূর্ত থেকে পাল্টে যাবে। আমাদের দেশের ভুলে যাওয়া নারী ও পুরুষকে আর ভুলে থাকা যাবে না। যখন আপনি আপনার হৃদয়কে দেশপ্রেমের জন্য উন্মুক্ত করে দেবেন তখন সেখানে কোনো পক্ষপাতিত্ব বা অবিচার থাকতে পারে না। আমি কখনোই আপনাদেরকে ফেলে রাখবো না। আমরা আমাদের স্বপ্নকে ফিরিয়ে আনবো। আমাদেরকে যাতে অনুসরণ করে সেজন্য আলোকিত করবো সবাইকে। আপনাদেরকে আবারো অবজ্ঞা করা যাবে না। ১৬ বছর আগে শুরু হয়েছে নতুন মিলেনিয়াম। তারপরও ট্রাম্প মনে করেন তিনি এখনো একটি ‘নিউ মিলেনিয়ামে’ দাঁড়িয়ে আছেন।
এটা সহজেই বলা যায় যে, কিছু কিছু বিষয় ঢিলেঢালাভাবে হয়েছে। ট্রাম্প দুটি কোয়ালিটি পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন। তাহলো কাঙ্ক্ষিত ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার। অন্যরা যখন এ দুটি জিনিস পেতে চাইছেন তখন যুক্তরাষ্ট্রে তা নেই কি? আমেরিকা কি শুধুই উগ্র কট্টরপন্থি ইসলামী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে? এক্ষেত্রে জয় পেলেই কি বিজয় পূর্ণতা পাবে। যেহেতু মুসলিমদের দেহেও একই দেশপ্রেমের এক লাল রক্ত প্রবাহিত হয়। তখন তারা যদি আহত হন তাহলে তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমদের সঙ্গে কেমন আচরণ করবেন?
ভয় পাবেন না। এই ব্যক্তির সম্পর্কে বিশ্ব মিডিয়াই খবর জানাবে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে সামনে আসবেন রাজনীতিকরা। এমনটা করেছেন কয়েকদিন আগে মাইকেল গভ। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের অধীনে ফিলিস্তিন ইস্যুতে কিভাবে অবস্থান থেকে সরে আসেন তা এরই মধ্যে দেখিয়েছেন তেরেসা মে। আরব দেশগুলো অপেক্ষা করছে। নতুন প্রেসিডেন্টের অধীনে তারা তাদের অবস্থান পরিষ্কার করবে। এতে ইসরাইলের বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। আমি ইসরাইলের মহান দার্শনিক, অধিকারকর্মী, লেখক, দেশপ্রেমিক, বামপন্থি ব্যক্তিত্ব ইউরি আভনারির কিছু উদ্ধৃতি তুলে না ধরে পারছি না। আভনারি ইসরাইলের প্রথম যুদ্ধের ৯৯৩ বছর বয়সী যোদ্ধা। ডনাল্ড ট্রাম্প শপথ নেয়ার দু’এক ঘণ্টা আগে তিনি বলেছেন, ‘ট্রাম্প একজন বিনোদন দানকারী প্রেসিডেন্ট হবেন। এখন প্রশ্ন হলো বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর একজন মানুষকে কি আমরা প্রকৃত অর্থেই বিনোদন দানকারী হিসেবে দেখতে চাই? অথবা অতিমাত্রায় ইগোম্যানিয়াক হিসেবে দেখতে চাই? যে মানুষ কিছুই জানে না তিনি বিশ্বাস করেন তিনিই সবকিছুর সমাধান করে ফেলবেন?’
সর্বশেষ তেল আবিবে আমি আভনারির সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। এরই মধ্যে তার শ্রবণশক্তিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তিনি এখনো মনে করতে পারে নাৎসী জার্মানিতে স্কুলগামী ছোট্টবেলার কথা। তিনি লিখেছেন, ওয়াশিংটনের শপথ গ্রহণের দিনটি ‘ঐতিহাসিক দিন’।
এমন ঐতিহাসিক দিন আমি পছন্দ করি না। আমি এমন দিনকে স্মরণ করি এভাবে, যেদিন জার্মানির বার্লিন দিয়ে সশস্ত্র প্যারেড করছে যুবক জার্মানরা।
(গতকাল অনলাইন দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে প্রকাশিত বিখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্কের লেখার ভাবানুবাদ)