রোহিঙ্গাদের বাসস্থানের নামে পাহাড়দখল

0

image-64736

দিনবদল ডেক্স: নির্যাতনের ভয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের বাসস্থান তৈরির নামে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পাহাড় একের পর এক দখলের উৎসব চলছে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং এলাকায়। কয়েকশ একর বিস্তৃত সরকারি পাহাড়ের বৃক্ষ নিধন করে অর্থের বিনিময়ে সেগুলোতে ঘরবাড়ি তৈরির অনুমতি দিচ্ছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ‘জমিদাররা’।

রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা থাকার কারণে স্থানীয় প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করছে বিষয়টি। সরকারি বন দখল করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ ধ্বংসে মেতে উঠেছে কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী এলাকার কতিপয় প্রভাবশালী।

কুতুপালং এলাকার নতুন রোহিঙ্গা বসতি এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি পাহাড় নিয়ন্ত্রণ করেন একেকজন জমিদার। তাদের কথাই পাহাড়ের আইন। রোহিঙ্গারা কোথায় কোন পাহাড়ে ঘর তুলবে, কতোটুকু জায়গা বরাদ্দ পাবে এর পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করেন জমিদাররা। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা প্রথমে দালালের মাধ্যমে জমিদারদের সঙ্গে আলাপ করে। তারপর নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ঘর নির্মাণের মৌখিক অনুমতি মেলে জমিদারের লোকদের কাছ থেকে। পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে ক্ষেত্রবিশেষে বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত গুনতে হয় ভালো ‘পজিশন’ এবং পছন্দের আয়তনের জন্য। এছাড়া বসতি গড়ে তোলা রোহিঙ্গাদের মাসপ্রতি তিনশ থেকে পাঁচশ টাকা ভাড়া দিতে হয় জমিদারদের।

এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুতুপালং রোহিঙ্গা বসতি এলাকার অলিখিত গডফাদার স্থানীয় রাজাপালং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত সদস্য মৌলভী বখতিয়ার আহমেদ। উখিয়া উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রোকন বখতিয়ার এখন দল পাল্টেছেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর জামায়াত ছেড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে ভিড়েছেন। তিনি এখন উপজেলা আওয়ামী মৎসজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পুরোটাই বখতিয়ারের নিয়ন্ত্রণে। বখতিয়ারের নেতৃত্বেই নতুন নতুন পাহাড় দখল করছেন তার অনুসারী জমিদাররা।

সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৮ পাহাড় নিয়ন্ত্রণে রয়েছে রিয়াদুল হক রিমু, নুরুল কবির ভুট্টো, ফরিদ আলম, কবির আহমদ, বুজুরুছ, জানে আলম, আলী আকবর, মো. ইসলাম। কাগজ-কলমে বন বিভাগের পাহাড় হলেও পাহড়গুলোর হর্তাকর্তা এই ৮ জন। তাদের মধ্যে রিয়াদুল হক রিমু এফিএফ নামের স্থানীয় একটি এনজিওতে কাজ করেন। পাশপাশি বখতিয়ারের ক্যাডার হিসেবে পাহাড়ে অধিপত্য ধরে রেখেছেন। বাকি সাতজনের প্রত্যেকেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী।

পাহাড় দখল করে প্রায় প্রতিটি পাহাড়ে গড়ে দেড়শ থেকে দুইশ ঘর নির্মাণ করেছেন এসব জমিদার। পাশাপাশি আরও বেশ কিছু পাহাড় দখলের কাজ চলছে। বেশ কয়েকটি ধাপে এই পাহাড়গুলো দখল করা হয়। প্রথমে পাহাড়ের গাছ কেটে বিক্রি করা হয়। তারপর আগুন লাগিয়ে পাহাড়ের লতা, গুল্ম প্রভৃতি ধ্বংস করা হয়। এরপর পাহাড়গুলো কেটে বসবাস উপযোগী করে তৈরি করার পর রোহিঙ্গাদের কাছে পজিশন আকারে বিক্রি করা হয়। তবে যেসব রোহিঙ্গা পাহাড় কিনছে তাদের কারো কাছে কোনো কাগজপত্র নেই। পাহাড়ের পজিশন নেওয়ার জন্য টাকার বিনিময়ে মৌখিক অনুমতি নিতে হয় জমিদারের লোকদের কাছ থেকে। পাহাড়ে ঘর নির্মাণের কাজটিও কয়েক ধাপে সম্পন্ন করে রোহিঙ্গারা। প্রথমে বাঁশ ও বাঁশের চাটাই দিয়ে কাঠামো তৈরি করে প্লাস্টিক দিয়ে ঘিরে ঘর নির্মাণ করা হয়। এর কিছুদিন পর পাহাড়ের লতা-গুল্ম দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় অস্থায়ী ঘরের সবগুলো দেওয়াল ও ওপরের ছাদ। কয়েক সপ্তাহ পর মাটির প্রলেপ দেওয়া হয় অস্থায়ী কাঠামোর ওপর। এভাবেই ধাপে ধাপে বাঁশের চাটাইয়ে খুপরিঘর থেকে মাটির ঘর তৈরি করা হয়।

নুরুল কবির ভুট্টোর নিয়ন্ত্রণাধীন পাহাড়ে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল এক রোহিঙ্গা পরিবারের সঙ্গে। সত্তর বছর বয়সী পরিবারপ্রধানের নাম সাব্বির আহমদ। ৮ সদস্যের পরিবার নিয়ে ৬ দিন আগে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় এসে পৌঁছেছেন তিনি। পাহাড়ের এক পাশে বাঁশ দিয়ে ঘর নির্মাণ করছিলেন তিনি। ঘর নির্মাণের অনুমতি কার কাছ থেকে নিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি কারো নাম বলতে রাজি হননি। শুধু জানান, স্থানীয় একজনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ঘর তুলছেন তিনি। এখানকার তার প্রতিবেশী সবাই এভাবে ঘর তুলেছেন বলেও জানান তিনি।

মিয়ানমারের নাপ্পোরা এলাকা থেকে কুতুপালং এলাকায় এসেছেন রহমতউল্লাহ। স্থানীয় জমিদারের মাধ্যমে পাহাড়ে ঘর তুলে পরিবারসহ বসবাস করছেন তিনি। এজন্য প্রতিমাসের হিসাবেও নির্ধারিত পরিমাণ টাকা দিতে হবে বলে জানান তিনি। টাকা কার কাছে দেন? জানতে চাইলে মুখ খোলেননি তিনিও। মিয়ানমারে সহিংসতার মাত্রা এখন কম। তারপরও তিনি কেনো বাংলাদেশে এসেছেন জানতে চাইলে বলেন, ওখানে জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। এখানে খাওয়া-পরার কষ্ট হলেও শান্তিতে পরিবার নিয়ে ঘুমানোর সুযোগ রয়েছে। এ কারণেই তিনি চলে এসেছেন। তার মতে, প্রায় প্রতিদিনই কম-বেশি রোহিঙ্গা বিভিন্ন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসছে একটু নিশ্চিত জীবনের আশায়।

বিশ বছর বয়সী নূর হালিমা। মিয়ানমারের মংডু এলাকার বাসিন্দা। দুই সন্তানের জননী। হালিমার ভাষ্যমতে, তার স্বামীকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নির্যাতন করে হত্যা করেছে। একই পরিবারের অপর সদস্য চল্লিশ বছর বয়সী হামিদা খাতুনের স্বামী নেজাম উদ্দিনকেও মিয়ানমারে হত্যা করা হয়েছে। নতুন জীবনের আশায় তারা বাংলাদেশে এসে বসত গড়েছেন বলে জানান। এখানে ঘর তুলতে কোনো সমস্যা হয়নিÑ জানতে চাইলে তারা বলেন, আমাদের যতটুকু সামর্থ্য ছিল তা দিয়েই এখানে ঘর তোলার অনুমতি পেয়েছি আমরা। প্রতিমাসে কীভাবে ঘরভাড়া দেবেনÑ জানতে চাইলে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।

অভিযোগ রয়েছে, পাহাড়ের জমিদারদের মূল কাজ হচ্ছে মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে এদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছে পাহাড়ের পজিশন বিক্রি করা। পরে ওই রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে ইয়াবা, মানবপাচার ও যৌনব্যবসা চালিয়ে থাকেন পাহাড়ের জমিদাররা। এভাবেই সরকারি পাহাড় দখল করে অপরাধের এক একটি স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলছেন জমিদাররা, যে কারণে পাহাড়গুলোতে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য ঘরবাড়ির পাশাপাশি গড়ে তোলা হয়েছে দোকানপাট, খেলার মাঠ, নলকূপ ও শৌচাগার। যদিও নলকূপ ও শৌচাগারগুলো পাহাড়ে কর্মরত বেসরকারি এনজিওগুলোর আর্থিক সহায়তায় নির্মাণ করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বখতিয়ার মেম্বার আমাদের সময়কে বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা। তিনি একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে এই এলাকার মানুষদের দেখাশোনা করেন মাত্র। পাহাড় দখল করে ঘর তৈরি ও ভাড়া দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানকার অনেক পাহাড় বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে রয়েছে। দখলকৃত পাহাড়গুলোতে টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গা বসতি গড়ে ওঠার খবর তিনি শুনেছেন এবং স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন।

সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে বন বিভাগের উখিয়া রেঞ্জের কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, আমার একার কিছু করার নেই। বিষয়টি আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেছি। যেহেতু রোহিঙ্গাদের বিষয়টি মানবিক। তাই সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল বিষয়টি নিয়ে ভাবছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা মাঝে-মধ্যে পাহাড়ে অবৈধ বসতি উচ্ছেদে অভিযান চালায়। কয়েকদিন পর আবার সেখানে বসতি গড়ে ওঠে। অনেক সময় এমনও হয়, উচ্ছেদ অভিযানে গিয়ে রোহিঙ্গাদের কাছে আমরা মার খেয়ে ফিরে আসি।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ড. হাছান মাহমুদের মতে রোহিঙ্গাদের জন্য ইতিপূর্বে কক্সবাজার এলাকার অনেক সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। নতুন যেসব রোহিঙ্গা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এসেছেন তাদের কারণে পরিবেশের অবস্থা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তিনি আমাদের সময়কে এ বিষয়ে বলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসে যেখানে বসতভিটা গড়ে তুলছে তার পুরোটাই সরকারি বনভূমির জায়গা। স্থানীয় কিছু ব্যক্তি তাদের এ কাজে সহয়তা করছে। বিষয়টি এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই কক্সবাজারের পরিবেশ মারাত্মক দূষণের ঝুঁকিতে পড়বে।

তিনি বলেন, সম্প্রতি সরকার রোহিঙ্গাদের ঠেঙ্গারচরের দ্বীপে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছেন। সেখানে তাদের জীবন ও জীবিকার ব্যবস্থাও করা হবে সরকারের পক্ষ থেকে। আমি মনে করি, যত দ্রুত এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে ততই আমাদের বনভূমির জন্য মঙ্গল।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *