মৃত্যুর আগে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যা বলেছিলেন
অনলাইন ডেক্স: গত ডিসেম্বরে এক সম্মেলনে যোগ দিতে লন্ডনে গিয়েছিলেন প্রয়াত পার্লামেন্টিরিয়ান সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। তখন তিনি ব্রিটেনের একটি সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘পুড়ে পুড়ে খাঁটি হওয়া সোনা’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
লন্ডনে সদ্যচালু হওয়া অনলাইন ‘‘সত্যবাণী ডটকম’’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সুরঞ্জিতের এই আলাপচারিতা তুলে ধরেছেন পত্রিকার এডিটর-ইন-চিফ সৈয়দ আনাস পাশা।
আনাস পাশা লিখেছেন, তিনি সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি বা আপনার অন্য প্রবীণ সহকর্মীরা প্রধানমন্ত্রীকে এই পরামর্শগুলো দেন কি না’ জবাবে সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বলেছিলেন- ‘পরামর্শের এখন আর প্রয়োজন পড়ে না শেখ হাসিনার। পুড়ে পুড়ে সোনা যেমন খাঁটি হয়, রাজনীতিতে পোড় খেতে খেতে শেখ হাসিনাও এখন ঝুনা হয়ে উঠেছেন’।
আনাস পাশা লিখেছেন, ‘লন্ডনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সাথে শেষ কথা হয় মাত্র মাস দেড়েক আগে। ১১-১৭ ডিসেম্বর কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) কনফারেন্সে যোগ দিতে যান লন্ডনে। উঠেন ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্রিজের পার্ক প্লাজা হোটেলে, কনফারেন্সও অনুষ্ঠিত হয় এখানে। এমনি এক সময় কনফারেন্সের বিরতিতে কথা হয় তাঁর সাথে। চেহারায় মরণব্যাধির আক্রমণের ছায়া। ক্লান্ত শরীর নিয়ে হোটেলে তাঁর রুমে বিছানায় বসেই তিনি কথা বলছিলেন।
সমসাময়িক রাজনীতি, চীনের সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সাক্ষাৎকার চাইলে বলছিলেন, ‘না কোনো ইন্টারভিউ নয়, এমনিই কতক্ষণ গল্প করি তোর সাথে’। এই আলাপচারিতা নিয়ে কোনো স্টোরি করতে নিষেধ করেন। কথা দিলাম, করব না। আলাপচারিতায় নিউজ আইটেম হওয়ার মত প্রচুর রসদ থাকার পরও তাঁর ইচ্ছের প্রতি সম্মান দিতে গিয়ে কোনো স্টোরি ঐ সময় করিনি। ব্যক্তিগত ঐ আলোচনায় সর্বশেষ রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে অনেক কিছুই বলেছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বলেছিলেন শেখ হাসিনার প্রতি তার আস্থার কথা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি প্রচন্ড ভরসা ছিল সদ্য প্রয়াত কিংবদন্তি এই রাজনীতিকের। এই ভরসা বা আস্থা শুধু তার একার নয়, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে শেখ হাসিনা পুরো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ারই আস্থার জায়গা, এই আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্বের বিকল্প নেই, এমনটিই মনে করতেন সেনগুপ্ত। চীনের সাথে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সম্পর্ক উন্নয়নে সতর্কভাবে আগানো উচিত বলে মনে করতেন প্রবীণ এই নেতা। এতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে কি না, এমন প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, ভারত আমাদের অন্যতম ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী, তাদের আস্থায় রেখেই চীনসহ অন্য প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, ‘ভারতকে রেখে আমরা চীনের সাথে কতটুকু যেতে পারব, সেই সীমানা চীনকেও বুঝতে হবে’। আপনি বা আপনার অন্য প্রবীণ সহকর্মীরা প্রধানমন্ত্রীকে এই পরামর্শগুলো দেন কি না, এমনটি জানতে চাইলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের এই তারকা রাজনীতিকের মন্তব্য ছিল, ‘পরামর্শের এখন আর প্রয়োজন পড়ে না শেখ হাসিনার। পুড়ে পুড়ে সোনা যেমন খাঁটি হয়, রাজনীতিতে পোড় খেতে খেতে শেখ হাসিনাও এখন ঝুনা হয়ে উঠেছেন’।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে শেখ হাসিনা যতটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রতিটিতেই সফল হয়েছেন, এমনটি দেখার পর আমরা এখন আর কোনো পরামর্শ দিতে যাই না। তাছাড়া দেশ ও দলের স্বার্থে বিভিন্ন সময় তিনি যে ঝুঁকি নিয়েছেন, তাতো আমরা অনেকেই নিতে পারিনি। সুতরাং ঝুঁকি নিচ্ছেন তিনি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ারও তার, বিষয়টি এভাবেই দেখা উচিত’।
তবে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শেখ হাসিনার আরও সতর্ক হওয়া উচিত বলে মনে করতেন সুরঞ্জিত। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য শেখ হাসিনাকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে’। ‘গ্লোবাল টেরোরিজম মোকাবেলায় শেখ হাসিনার কাছ থেকে বিশ্ব নেতাদের অনেক কিছু শেখার আছে’ এমন মন্তব্য করে উপমহাদেশের প্রবীণ এই পার্লামেন্টারিয়ান বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা যে এখন দক্ষিণ এশিয়ার ‘অ্যাসেট’ এটি এই অঞ্চলের মানুষ বুঝতে শুরু করেছে’।
একান্ত ঐ কথোপকথনে আরো অনেক কথা বলতে চেয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কিন্তু খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাকে। এক পর্যায়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কথা বলতে থাকেন। বলেন, ‘আধুনিক বিশ্বের কাতারে শামিল হতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দৌড়াচ্ছে বাংলাদেশ। এই দৌড়ে যোগ দিতে গিয়ে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকারের মত বিষয়গুলো গুরুত্বহীন হয়ে যেন না পড়ে’।
দলীয় নেতাকর্মীদের একটি অংশের কাছে শেখ হাসিনার ভিশনের চেয়ে ব্যক্তিগত লাভালাভ গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি, আলাপচারিতায় এমন অভিযোগও করেন প্রবীণ এই রাজনীতিক। বলেন, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নেতাকর্মীরা যে সময় ব্যয় করছেন, শেখ হাসিনার উন্নয়ন কর্মকান্ডের খবর তৃণমূলে পৌঁছে দিতে সেই সময় ব্যয় করলে উন্নত দেশ হতে ২০৪১ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো না বাংলাদেশকে।
উল্লেখ্য, গত ৫ ফেব্রুয়ারি ভোর রাত ৪টা ২৪ মিনিটে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন বর্ষীয়ান নেতা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।