মুক্তিযুদ্ধের সময় যে স্লোগান দিতেন কামরান

0

83027

দিনবদল ডেক্স: ১৯৭১ সাল। উত্তাল সময়। পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়ছে বাংলার মুক্তিকামী জনতা। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর গোটা বাংলা। সে সময় দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। বর্তমানে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সদস্য তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় মিছিল-মিটিংয়ে ছুটে যেতেন তিনি। ধরতেন প্রতিবাদী স্লোগান।

দিনবদল নিউজকে একান্ত আলাপকালে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক এই মেয়র।

কামরান বলেন, ‘১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১ মার্চ ডাকা হয় জাতীয় অধিবেশন। কিন্তু সেই অধিবেশন যখন স্থগিত করা হয় তখন আমরা বুঝে যাই পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহনা শুরু করেছে। পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে সারাদেশের মতো সিলেটের মানুষও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ক্ষোভ রাজপথের আন্দোলনে রূপ নেয়। একসময় সিলেটের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, ছাত্র-জনতা পাকিস্তান বিরোধী স্লোগান নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। সবার মুখে মুখে ছিল একই স্লোগান- ‘তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা। তুমি কে, আমি কে- বাঙালি, বাঙালি।’

তিনি বলেন, ‘১ মার্চের পর থেকে প্রতিদিন সকাল ১০টার দিকে নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন মিছিল নিয়ে সুরমা মার্কেট পয়েন্ট ও কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় জড়ো হতো। দক্ষিণ সুরমা থেকে বিশাল বিশাল মিছিল আসতো। পরে সবাই মিলে নগরীতে বিশাল মিছিল হতো। বিকেলে সমাবেশ হতো। ১৯৭১ সালে আমি সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র। আমার বয়স তখন ১৭। সুযোগ পেলেই আমি মিছিলে ছুটে যেতাম। বড়দের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে স্লোগান ধরতাম।’

বদর উদ্দিন কামরান বলেন, ‘৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বঙ্গবন্ধু ভাষন দেবেন। আগের দিন থেকে সিলেটের মানুষ উদগ্রিব হয়ে ওঠেন সেই ভাষন শোনার। দুপুর থেকে মানুষ রেডিও’র সামনে জড়ো হতে থাকেন। কিন্তু সিলেট বেতার থেকে ঐতিহাসিক সেই ভাষন সম্প্রচার না করায় সিলেটের মানুষ তা শোনা থেকে বঞ্চিত হন। এতে সিলেটের মানুষের ক্ষোভ আরো বেড়ে যায়। যাদের বাসায় টিএন্ডটি ফোন ছিল ঢাকায় যোগাযোগ করে তারা জানতে পারেন বঙ্গবন্ধু তার ভাষনের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন। জনতার ক্ষোভের মুখে পরদিন সকালে সিলেট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষন শুনতে পান। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষন কেবল বক্তৃতামালা ছিল নয়, এর মধ্যে ছিল যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ ও স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর সিলেটের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও একই সাথে প্রতিরোধের মনোভাব গড়ে ওঠে।’

‘বঙ্গবন্ধু জানতেন রক্ত ছাড়া স্বাধীনতা আসবে না। তাই তার বক্তৃতায় বলেছিলেন- ‘রক্ত যখন দিয়েছি, আরো দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইন শা আল্লাহ!’ তিনি জানতেন এই যুদ্ধে প্রাণহানী ঘটবে। এমন প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য তার বক্তৃতায় স্পষ্ট উচ্চারণ ছিল, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না’- বলে চলেন কামরান।
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই বক্তব্য আত্মস্থ করতে পেরেছিল সিলেটের মানুষ। তাই এই বক্তব্যের পরই সিলেটে মূলত মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। প্রতিদিন শহরে বিশাল বিশাল মিছিল হয়। প্রায়ই সেই মিছিলে যেতাম। সারাদিন মিছিল করে বাসায় ফিরতাম।’

কামরান আরো বলেন, ‘‘নগরীর নয়াসড়কে বর্তমানে যেখানে খাজাঞ্চিবাড়ি স্কুল ১৯৭১ সালে সেখানে ছিল ইপিআর ক্যাম্প। মার্চের শেষের দিকে (সম্ভবত ২০-২৩ মার্চের মধ্যে হবে) ইপিআর ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে বের করা হয় মিছিল। দেওয়ান ফরিদ গাজীর নেতৃত্বে সেই মিছিলে অংশ নেই আমি। হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে মিছিলটি যখন জেল রোড পয়েন্টে যায় তখন ইপিআর ক্যাম্প থেকে গুলি ছোঁড়া হয়। গুলি ছুঁড়ে ইপিআর সদস্যরা মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তখন আমাদের মিছিলের স্লোগান ছিল- ‘বাঁশের লাঠি তৈরি কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। সংহতিতে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।’

কামরান স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘২৪ মার্চ মিছিল করে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বাসায় ফিরি। বাসায় এসে জানতে পারি আমার চাচা গোলাম রব্বানী অসুস্থ হয়ে সিলেট সদর হাসপাতালে ভর্তি। ২৬ মার্চ তিনি হাসপাতালে মারা যান। তখন রাস্তায় বের হওয়া যাচ্ছিল না। রাস্তায় পাক আর্মি ঘুরাফেরা করছিল। এই অবস্থায়ই লাশ আনতে রওয়ানা দেই হাসপাতালে। পথে জিন্দাবাজারের যেস্থানে বর্তমানে সোনালী ব্যাংক রয়েছে সেখানে রাস্তায় কয়েকজন বাঙালি পুলিশের লাশ পড়ে থাকতে দেখি। ফেরার সময় মির্জাজাঙ্গাল নির্ম্বাক আশ্রমের সামনে আরেক ব্যক্তির লাশ পড়ে থাকতে দেখি। লাশের পায়ের অংশ ক্ষত-বিক্ষত। মনে হচ্ছিল রাতে শেয়াল বা কুকুর হয়তো লাশের অংশ বিশেষ খেয়ে ফেলেছে। দুইঘন্টার জন্য কারফিটউ শিথিল হলে তাড়াহুড়ো করে আমরা চাচার লাশ দাফন করি।’

তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সিলেটের বাণিজ্যিক এলাকা কালিঘাটে প্রায়ই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গাড়ি আসতো। আমরা তাদেরকে প্রতিরোধ করার জন্য পার্শ্ববর্তী সোমিল থেকে গাছের গুঁড়ি ও দোকান থেকে তেলের ড্রাম রাস্তায় ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টির চেষ্টা করতাম।’ ।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *