মানব পাচারকারীদের ফাঁদে পরে সর্বসান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ

0

arrest_44511_1491918417

দিনবদল ডেক্স: কোন টাকা লাগবে না বিদেশ যেতে পাচারকারীদের এরকম বক্তব্য, সমাজের স্বল্প শিক্ষিত, আয়-রোজগার কম। ছোটখাটো চাকরি, অথচ সামান্য জমি-জায়গা আছে। এমন মানুষই তাদের টার্গেট। এদের জন্যই ফাঁদ পাতে তারা। প্রলোভন দেখায় একেবারেই বিনা পয়সায় বিদেশ নিয়ে যাওয়ার। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও করে দেয় তারাই। পাচারকারীরা বলে থাকে, সেখানে গিয়ে কাজ করেই টাকা পরিশোধ করতে পারবে। আর এই ফাঁদে পা দিয়ে জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনে সহজ-সরল মানুষগুলো। বিদেশের মাটিতে আটকে রেখে চালানো হয় চরম নির্যাতন। মুক্তিপণের টাকা যোগাড় করতে গিয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করে নিঃস্ব হতে হয় অনেকের। মুক্তিপণের টাকা দিতে ব্যর্থ হলে হত্যা করে লাশ গুমও করে ফেলা হয় কখনো কখনো। দীর্ঘদিন ধরে একাধিক প্রতারক চক্র এই কৌশলেই মানবপাচার করে চলছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে চক্রটি ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও।

এ ধরনের একটি ভয়ঙ্কর চক্রের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সোমবার রাতে এই চক্রের এক সদস্যকে আটক করেছে তারা। তার নাম এমএ হান্নান ওরফে মল্লিক আবদুল হান্নান (৩৪)। তাকে রাজধানীর পুরানা পল্টন সাব্বির টাওয়ারের সামনে থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর হান্নান এই চক্র সম্পর্কে নানা তথ্য দিয়েছে। তিনি চক্রটির মাঠপর্যায়ের দালাল। তার কাজ লোক সংগ্রহ করে তাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে বিদেশ যেতে রাজি করানো। পরবর্তী কাজ অন্যদের। এরপর সেই দেশে থাকা চক্রের হোতারা জিম্মি করে দাবি করে মুক্তিপণের মোটা অঙ্ক। সহজে মুক্তিপণ দিতে রাজি না হলে চলে অমানুষিক নির্যাতন। অনেক সময় দাবিকৃত মুক্তিপণ না পেয়ে পাচারকারীকে হত্যাও করে তারা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে ও আদালতের কাছে দেয়া জবানবন্দিতে এমনটাই জানিয়েছেন গ্রেপ্তারকৃত হান্নান। তিনি জানান, এ পর্যন্ত তিনি এভাবে ১০ জনকে লিবিয়া পাঠিয়েছেন। যাদের একজন মুন্না। সে এখনো লিবিয়ার একটি অজ্ঞাত স্থানে আটকা রয়েছে। মুন্নার বরাত দিয়ে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তার সঙ্গে আরো ৫ বাংলাদেশি একই স্থানে আটকা রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত হান্নানের বরাত দিয়ে পিবিআই কর্মকর্তা এসআই মো. জুয়েল মিঞা আরো জানান, একজন বন্দির কাছ থেকে ৩-৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করলেও হান্নান পেতো ৩০-৪০ হাজার টাকা।

পিবিআই সূত্র জানায়, বর্তমানে লিবিয়ায় আটক মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় থানার আড়পাড়া গ্রামের মো. জিন্নাহ শেখ গত ২৮শে মার্চ অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। এতে তিনি জানান, তার যমজ ভাই মুন্না ফকিরাপুল এলাকায় একটি প্রেসে চাকরি করতো।

গত ৪ঠা মার্চ সহিদুল ইসলাম ওরফে সুমন নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে লিবিয়ায় যায়। এরপর ১৩ই মার্চ রাত সাড়ে ১২টার দিকে তার মোবাইলে একটি বিদেশি নম্বর থেকে ভিডিও কল করে তার ভাই মুন্না বলে- ‘আমি তোর ভাই মুন্না, এখন লিবিয়া আছি। যারা আমাকে লিবিয়া আনছে তারা ৪ লাখ টাকা চায়। তাদের চাহিদা মতো টাকা না দিলে আমাকে তারা মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়।’ জিন্নাহ ওই ভিডিওতে মুন্নার পাশে আরো ২-৩ জনকে দেখতে পান। তারা টাকার জন্য মারধর করা এবং তার চিৎকারও শুনতে পান। আটক মুন্না টাকা পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের সিটি ব্যাংক লিমিটেডের একটি একাউন্ট নম্বর দেয়। একইসঙ্গে পাচারকারী চক্রও বিভিন্ন নম্বর থেকে জিন্নাহসহ তার পরিবারের লোকজনকে ফোন করে ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।

মতিঝিল থানা থেকে মামলাটি ঢাকা মহানগর পিবিআই-এ স্থানান্তর করা হয়। এ বাহিনী আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মো. বশির আহমেদের নেতৃত্বে একটি টিম গত সোমবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে পুরানা পল্টন সাব্বির টাওয়ারের সামনে থেকে মানবপাচার করে মুক্তিপণ আদায়কারী সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য এমএ হান্নান ওরফে মল্লিক আবদুল হান্নানকে আটক করে।

পিবিআই কর্মকর্তা এসআই জুয়েল জানান, আটক এমএ হান্নান ওরফে আবদুল মল্লিক হান্নান জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে তার বাড়ি বাগেরহাট জেলার সদর থানার সাবেক ডাঙ্গা গ্রামের মল্লিকের ছেলে। দীর্ঘদিন থেকে রাজধানীর শাহজাহানপুরের শান্তিবাগ এলাকায় বাস করছিলেন। রাজধানীতে তাদের রয়েছে মানবপাচার চক্রের বিশাল এক সিন্ডিকেট। তিনি ও সিন্ডিকেটের পলাতক সদস্য সহিদুল ইসলাম সুমন, শহিদ, নজরুল ইসলাম সুমন, রয়েল এবং কাজী ইসমাইলসহ অনেকে তাদের নির্ধারিত এজেন্টের মাধ্যমে বিনা টাকায় বিদেশে পাঠানোর প্রলোভন দিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লোক সংগ্রহ করে। যাদের জমি-জমা আছে কিন্তু স্বল্প শিক্ষিত, সহজ-সরল, কম বেতনে ছোটখাটো চাকরি করে এমন লোকজনদেরকে টার্গেট করে সিন্ডিকেটের সদস্যরা বেশি বেতনে বিদেশে চাকরি দেয়ার এবং বিদেশে গিয়ে কাজ করেও টাকা পরিশোধের প্রলোভন দেখায়। বিনা টাকায় বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে তারা খুব সহজেই রাজি হয়ে যায়। এরপর চক্রের কাগজপত্র করে বিদেশে পাঠানো হয়। বিদেশে থাকা সিন্ডিকেটের মূল হোতা কাজী ইসমাইল তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে রুমের মধ্যে জিম্মি করে ফেলে। পরে ভিকটিমদের মাধ্যমে ফোনে বিষয়টি তাদের দেশের আত্মীয়স্বজনদের জানায়। মারধরের দৃশ্য ভিডিওতে দেখায় এবং সিন্ডিকেটের চাহিদা মতো টাকা দিয়ে তাদেরকে মুক্ত করতে বলে। টাকার বিনিময়ে এই চক্রের হাত থেকে মুক্তি মেলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট তাদের চাহিদা মতো টাকা না পেলে জিম্মিকৃত ব্যক্তিদেরকে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলে বলেও হান্নান স্বীকার করে।

পিবিআই আরো জানতে পারে, সংঘবদ্ধ চক্রটি লিবিয়া, কাতার ও মালয়েশিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশে মানবপাচার করে মুক্তিপণ আদায় করে। সিন্ডিকেটের এমএ হান্নান ওরফে মল্লিক আবদুল হান্নান, শহিদ এবং রয়েল লোক সংগ্রহ করে দেশের আঞ্চলিক লিডার সহিদুল ইসলাম সুমনের কাছে বুঝিয়ে দেয়। সুমন যাদের পাসপোর্ট করা নেই তাদের পাসপোর্ট করে নজরুল ইসলামে কাছে তুলে দেয়। নজরুল ভিসা, টিকিট, বোর্ডিং পাস, ইমিগ্রেশন ইত্যাদি দেখে অর্থাৎ এয়ারপোর্ট পার করানোর দায়িত্ব তার। বিদেশে থাকা সিন্ডিকেটের মূল হোতা কাজী ইসমাইল তার নিজস্ব এজেন্টের মাধ্যমে দুবাই থেকে তাদের গ্রহণ করে তার নিয়ন্ত্রণে নেয়। পরে বাংলাদেশে সুমনের মাধ্যমে মুক্তিপণের টাকা পাওয়ার পর কাজী ইসমাইল তার ভাগের টাকা পেলেই ভিকটিম মুক্তি পায়।

এদিকে গতকাল বিকালে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে হান্নান। তাতে বলেছে, ৪ বছর আগে তিনি মালয়েশিয়া থাকতেন। দেশে ফিরে এসে জড়িয়ে পড়েন মানবপাচারকারী চক্রের সঙ্গে। এদিকে লিবিয়ায় আটক মুন্নার পরিবার জানায়, মুন্না তাদের জানিয়েছিলো তার সঙ্গে সেখানে আরো ৫ বাংলাদেশি জিম্মি রয়েছে। তাদের পরিবারের কাছ থেকেও মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করেছে চক্রটি।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *