বিএনপি তলে তলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে!

0

০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩০বঙ্গাব্দ,
১৯ নভেম্বর ২০২৩ ইং
আব্দুস সাত্তার
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই সারাদেশ এখন নির্বাচনমুখী। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে ছোট বড় অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দল মাঠে নেমেছে। আওয়ামী লীগসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ৩০০ আসনের মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু করেছে।
অন্যদিকে বিএনপি এখন পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তের কথা জানালেও, তলে তলে প্রস্তুতি নিচ্ছে। ২০০৮ সালে নবম সংসদ এবং ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও বয়কটের ঘোষণা দিয়ে শেষ মুহূর্তে অংশ নিয়েছিলো দলটি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও এমনটি হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
নির্বাচনের ইতিহাস বলছে, নবম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয় বিএনপি, কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ভোটে আসে দলটি। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে বিএনপির পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। সে সময়ের নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া অনুরোধ করেছিলেন দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার দুই ছেলে তারেক রহমান ও কোকোকে যেন বিনা শর্তে মুক্তি দেয়া কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার খালেদা জিয়ার অনুরোধ নাকচ করে ।
ফলে ছেলেদের মুক্তি ছাড়া খালেদা জিয়া তার দল বিএনপি নির্বাচনে অংশ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য খালেদা জিয়া ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়। সে অনুযায়ী, দুর্নীতিগ্রস্ত তারেক রহমান ও কোকো আর কখনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না মর্মে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পেয়ে বিদেশে চলে যায় এবং বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়।
এ প্রসঙ্গে ‘বাংলাদেশ: ইমার্জেন্সি অ্যান্ড দ্যা আফটারম্যাথ (২০০৭-২০০৮)’ শিরোনামের বইতে বিএনপির প্রয়াত নেতা মওদুদ আহমদ উল্লেখ করেছেন যে, ছেলেদের মুক্তি এবং বিদেশ পাঠানোর বিনিময়ে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নেয়ার শর্ত মেনে নিয়েছিলেন।
২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের পূর্বেও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সরব ছিল বিএনপি। সে সময় তারা প্রথমে দাবি করেছিল, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না। কিন্তু সংবিধান মোতাবেক দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের শক্ত অবস্থানের ফলে এক পর্যায়ে বিএনপির নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট জোট নির্বাচনে আসে।

২০১৮ সালের নির্বাচনে ভরাডুবির পর নির্বাচনের ফল বয়কট করেছিল বিএনপি। কিন্তু সংসদে নিজেদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি মাথায় রেখে ৬ নির্বাচিত ও একজন সংরক্ষিত মোট ৭ জনকে সংসদে পাঠিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু পরে সংসদীয় ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে সাত সংসদ সদস্যই সংসদ থেকে পদত্যাগ করে এবং দলীয়ভাবে বিএনপি রাজপথেই সব দাবির উপর আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।
ঈদের পর আন্দোলন, ৩১ দফা, ১৪ দফা, ৪ দফা, ১ দফা আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েও জনসম্পৃক্ততা না থাকায় সব আন্দোলনেই ব্যর্থ হয় বিএনপি। সবশেষ চলতি বছরের ২৮ অক্টোবর সরকার পতনের দাবিতে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলন করে বিএনপি। কিন্তু তাতেও আন্দোলনের ফলাফলের দিক থেকে তেমন সুবিধা করতে পারেনি বিএনপি। উল্টো আন্দোলনের নামে ব্যাপক সহিংসতায় জড়ায় বিএনপি।
অবস্থান পরিবর্তনের জন্য বিএনপি রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামের দিকে ধাবিত হলে সেখানেও ব্যর্থ, আবার নির্বাচনে অংশ না নিলে সংসদেও তাদের প্রতিনিধি থাকবে না। এই অবস্থায় দলটি অস্তিত্ব সংকটে পরবে, তা দলের শীর্ষ নেতাদের সবারই জানা। তাই বিএনপি এই মুহূর্তে সবার অগোচরে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রাথমিক প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক হারুন অর রশিদ বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে বছরের শুরু থেকেই দেশে বিদেশি তৎপরতা ছিল চোখে পরার মতো। একের পর এক পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বিএনপি প্রীতিও এখন কারো অজানা নয়। রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে সুবিধা পাইয়ে দিতে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছেন। দফায় দফায় বৈঠক করেছেন বিএনপি নেতাদের সাথে, এমনকি সরকারকে চাপে ফেলতে ভিসা নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু সব পদক্ষেপেই ব্যর্থ হয়েছে বিদেশিরা।

সবশেষ শর্তহীনভাবে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে বসতে আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাতেও খুব একটা সুবিধার আওতায় আসতে পারছে না বিএনপি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংলাপের সময় ফুরিয়ে গেছে বলে সংলাপের আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
বিদেশি তৎপরতার সব চেষ্টাই আপাতত শেষ বলে ধারণা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। বিএনপি এতদিন যে বিদেশিদের ঘাড়ে ভর করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেয়েছিল সে আশারও গুড়েবালি। তাই এই মুহূর্তে সব পরিকল্পনাকে পাশ কাটিয়ে বিএনপি তলে তলে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে যে গুঞ্জনটি শোনা যাচ্ছে তা একেবারে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই।

২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমে ১৮ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করে তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে নির্বাচনের তারিখ আরও ১১ দিন পিছিয়ে ২৯ ডিসেম্বর করতে পুনরায় তফসিল ঘোষণা করা হয়।
একইভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে, ৮ নভেম্বর ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। ২৩শে ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা হলেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের দাবির প্রেক্ষিতে ১২ নভেম্বর পুনঃতফসিলে তা পিছিয়ে ৩০শে ডিসেম্বর নির্ধারিত হয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাংবাদিক সুভাষ সিংহ রায় বলেন, তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে, বিএনপির বোধহয় আর নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ নেই। এ রকম ভাবার কোন অবকাশ নেই। বিএনপি যদি নির্বাচনে আসে এবং পুনঃ তফসিলের আবেদন করে তাহলে অবশ্যই তাদের আবেদন বিবেচনা সাপেক্ষে ভোটের দিন নতুনভাবে নির্ধারণ করার সুযোগ রয়েছে।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ছাদেকুল আরেফিন বলেন, বিএনপি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার একটা শক্ত কারণ হচ্ছে, যদি বিএনপি নির্বাচনে না আসে তাহলে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বহু নেতাই তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দেবে। তৃণমূল বিএনপি ইতোমধ্যেই ৩০০ আসনে তাদের প্রার্থী দেবার ঘোষণা দিয়েছে। এছাড়াও বিএনপি ভেঙে বিএনএফ, স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চ নামের আরও কয়েকটি দল গঠিত হয়েছে, যাদের নেতৃত্বে রয়েছে বিএনপিরই সাবেক নেতারা। এ দলগুলোও আসন্ন নির্বাচনে জোটগতভাবে কিংবা স্বতন্ত্র হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *