চাপে গার্মেন্টস খাত

0

1487266466

দিনবদল ডেক্স: সাম্প্রতিক আশুলিয়ার গার্মেন্টসে শ্রম অসন্তোষ ও এর জেরে কিছু শ্রমিকের চাকরিচ্যুতি ও মামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতিবাচক প্রচারণা শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক অধিকার সংগঠন এ ঘটনায় উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি তৈরি পোশাকের ক্রেতাদের কাছেও নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে। ইস্যুতে বিদেশি ক্রেতা এবং ব্র্যান্ডগুলো গার্মেন্টস মালিকদের কাছে জানতে চাওয়ার পাশাপাশি নিজেদের উদ্বেগও প্রকাশ করছে।

কেউ কেউ এ ঘটনাকে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর সবচেয়ে বড় উদ্বেগজনক ঘটনা বলে মনে করছেন। ইউরোপ ও আমেরিকার একাধিক দেশে এসব সংগঠনের ব্যানারে বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে চলতি সপ্তাহে অবস্থান ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী নতুন করে প্রচারণা পাচ্ছে গার্মেন্টসে বাংলাদেশে সবচেয়ে কম মজুরির বক্তব্য। ফলে ইস্যুটিতে নতুন করে চাপের মুখে পড়েছেন গার্মেন্টস মালিকরা।

একই ইস্যুতে গতকাল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে আটক শ্রমিক নেতাদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থার ডেপুটি এশিয়া ডাইরেক্টর ফিল রবার্টস বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্টস ক্রেতা ব্র্যান্ড ও সহযোগী সংস্থাগুলোর এ বিষয়ে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত’।

এছাড়া একই ইস্যুতে গত মাসের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতি, মামলা ও আটকের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছিল ইউরোপের ক্রেতাদের সমন্বয়ে গঠিত গার্মেন্টস পরিদর্শন জোট অ্যাকর্ড। একই সঙ্গে এ খাতের শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর আহ্বানও জানিয়েছিল তারা।

গার্মেন্টস উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নতুন করে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি উঠা ও তা ক্রমেই জোরালো হওয়ায় মালিকদের উপর এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি হয়েছে। দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট ও অবকাঠামো দুর্বলতাসহ বেশকিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে তাদের। এর মধ্যে এসব খাতে ক্রমাগত খরচ বাড়ছে। ফলে সার্বিকভাবে উত্পাদন খরচ বাড়ছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাকের দর বাড়ছে না। বরং ক্রমাগত কমছে বলে মালিকপক্ষের দাবি। এর উপর রানা প্লাজা ধসের পর চলমান কারখানা সংস্কারে বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করতে হচ্ছে।

তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, ‘সংস্কারের জন্য প্রতিটি কারখানাকে গড়ে প্রায় ৫ কোটি টাকা করে খরচ করতে হচ্ছে। এ চাপ সামলাতে না পেরে বেশকিছু কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। আবার যারা সংস্কারে পিছিয়ে আছে, তাদের সাথেও ব্যবসা বাতিল করছে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সভুক্ত বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। ইতোমধ্যে প্রায় দেড়শ’ কারখানার সঙ্গে ব্যবসা বাতিল করেছে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স’।

এমন পরিস্থিতিতে সামপ্রতিক আশুলিয়া ইস্যুতে এবার শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চাপও। আন্তর্জাতিক গার্মেন্টস অধিকার সংগঠন ইউনি গ্লোবাল ইউনিয়ন, ইন্ডাস্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়ন, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন, ক্লিন ক্লথস ক্যাম্পেইন আশুলিয়া পরিস্থিতি নিয়ে ক্রমাগত তাদের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ওই ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া শ্রমিক নেতাদের মুক্তির দাবিতে ‘এভরি ডে কাউন্টস’ নামে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ক্লিন ক্লথস ক্যাম্পেইনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি সপ্তাহ জুড়ে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোর বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে অবস্থান ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে। সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত ইন্ডাস্ট্রিঅল এশিয়া প্যাসিফিক নির্বাহী কমিটির এক সভায়ও বাংলাদেশে আশুলিয়ার ঘটনায় আটক শ্রমিক নেতাদের দ্রুত মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

গত ১১ ডিসেম্বরে আশুলিয়ায় মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে একটি কারখানায় শ্রমিকরা হঠাত্ কর্মবিরতি শুরু করেন। কর্মবিরতি অন্যান্য কারখানায়ও ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিক নেতা, মালিকপক্ষ ও শিল্পাঞ্চল পুলিশের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, এর কিছুদিন আগে ওই এলাকায় কিছু বেনামি লিফলেট ছড়িয়ে দিয়ে শ্রমিকদের মজুরি ১৫ হাজার টাকা করার দাবি তোলা হয়। এর পর থেকে এ কর্মবিরতি শুরু হয়। কারখানা মালিক, শ্রমিকদের একটি বড় অংশ ও সরকারের একাধিক মন্ত্রী আলোচনা চালিয়েও ব্যর্থ হন। এভাবে একের পর এক কারখানা বন্ধ হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়ে মালিকপক্ষ। ১৯ ডিসেম্বর নাগাদ কর্মবিরতির শিকার হওয়া কারখানা ৫০ ছাড়িয়ে যায়। এর পর হার্ডলাইনে যায় মালিক ও সরকারপক্ষ। শ্রম আইনের ১৩(১) ধারা অনুযায়ী কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। মামলা করা হয় দেড় হাজারের বেশি শ্রমিক ও শ্রমিক নেতার বিরুদ্ধে। তাদের বেশিরভাগকেই সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। আটকও করা হয় কয়েকজন শ্রমিক নেতাকে।

এর পর থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শুরু হতে থাকে প্রতিক্রিয়া। স্যাম মেহের নামে ক্লিন ক্লথস ক্যাম্পেইনের একজন প্রতিনিধির বরাত দিয়ে বলা হয়, রানা প্লাজার পর এটি গার্মেন্টসের জন্য বড় ধাক্কা। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ মূল বাজার হারাতে পারে। এটি বাংলাদেশের নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরির প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে। শ্রমিকদের মত প্রকাশের জন্য সংগঠিত হওয়ার অধিকারের পাশাপাশি তাদের বাঁচার মতো মজুরি নিশ্চিত করতে হবে।

এমন প্রতিক্রিয়া যৌক্তিক নয় বলেই মনে করেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা। বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাসির ইত্তেফাককে বলেন, আশুলিয়ার ঘটনাটি এখন মীমাংসিত ইস্যু। ওই ঘটনায় আটক কেউ প্রকৃত অর্থে শ্রমিক নেতা নন। তারা কথিত শ্রমিক নেতা। এর পর থেকে ওই সব কারখানায় যথারীতি উত্পাদন কাজ চলছে। কারখানা খোলার পর শ্রমিকের উপস্থিতি ছিল প্রায় শতভাগ। এখন ওইসব কারখানায় শান্তিপূর্ণভাবে কাজ চলছে। তিনি বলেন, স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যাদের বিষয়ে অভিযোগ ছিল তাদেরই আটক করা হয়েছে। বর্তমানে তাদের অনেকেই জামিনে আছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতি

মামলার মুখে পড়া শ্রমিক নেতারা দৃশ্যত ফৌজদারি মামলার মুখে পড়েছেন বলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতিতে বলা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, কিছু শ্রমিক নেতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে অভিযোগ আনা হয়েছে। পুলিশের হাতে নির্বিচারে গ্রেফতারের ঘটনা প্রতিদিনই বাড়ছে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি শ্রমিক ইউনিয়নের আরো নয়জন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। সবমিলিয়ে দৃশ্যমান গ্রেফতারের সংখ্যা ৩৪। এখনো যারা আটক অবস্থায় আছেন কর্তৃপক্ষের উচিত শিগগিরই তাদের মুক্তি দেওয়া এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সব অভিযোগ তুলে নেওয়া।

গ্রেফতারকৃতদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এ ব্যাপারে শ্রমিক অধিকার সংগঠন, আইনজীবী এবং শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেছে সংস্থাটি। নজর রেখেছে পুলিশ রেকর্ডের ওপরও। এসবের ভিত্তিতে গ্রেফতারকৃতদের সম্পর্কে উঠে এসেছে এক ভিন্ন চিত্র। আর তা হচ্ছে, অপরাধের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের চেয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতেই অধিক আগ্রহী পুলিশ। আশুলিয়ার ধর্মঘট পয়েন্ট থেকে গ্রেফতারকৃতদের অনেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশে পুলিশকে দেওয়া ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হচ্ছেন।

ফিল রবার্টসন বলেন, বেতন নিয়ে শ্রমিকদের ক্ষোভের দিকে নজর দেওয়ার বদলে বরং শ্রম অধিকারকর্মীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা এবং শ্রমিকদের আতঙ্কিত করে তোলা হলে তা বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করবে। শ্রমিকদের জন্য কাজ করছে বলে গার্মেন্টস মালিক ও সরকারের এমন বক্তব্য উপহাস হিসেবে গণ্য হবে। বাংলাদেশ থেকে পণ্য সংগ্রহকারী আন্তর্জাতিক ব্রান্ড এবং দাতা সংস্থাগুলোর উচিত- শ্রমিক অধিকারকর্মীদের ওপর নিপীড়ন বন্ধে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *