চলন্ত ট্রেনে যাত্রীবেশে বেপরোয়া ছিনতাইকারী থেকে সাবধান
দিনবদল ডেক্স: প্রথম দেখায় মনে হবে যাত্রী। বসে আছে ট্রেনের কামরায় কিংবা ছাদে। মুহূর্তে পাল্টে যায় তাদের চেহারা। একজন, দু’জন নয়— এরা যাত্রীবেশে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী। সুযোগ পেলেই নেমে পড়ে ‘আসল কাজে’।
চলন্ত ট্রেনে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। সাদা চোখে মনে হয় দুর্ঘটনা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এগুলো নির্মম হত্যাকাণ্ড। ঘাতকরা সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী। গত মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি) গাজীপুরের হায়দারাবাদ এলাকায় সফিকুল ইসলাম (৩৫) নামে মালয়েশিয়া প্রবাসী এক যুবক এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণ হারালে, চলন্ত ট্রেনে যাত্রীবেশে ছিনতাইকারী-ঘাতকদের দৌরাত্ম্য আবারও আলোচনায় উঠে আসে।
রেলওয়ে পুলিশের এক হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে সারাদেশে দু’টি রেলওয়ে জেলায় হত্যাকাণ্ডের মামলা হয়েছে মাত্র ২০টি— রেলওয়ে পশ্চিম জেলায় ৬টি ও রেলওয়ে পূর্ব জেলায় ১৪টি। অথচ গত বছরের প্রথম নয় মাসেই সারাদেশের ২৪টি রেলওয়ে থানা এলাকায় উদ্ধার হয়েছে ৭৩০টি লাশ। এসব লাশ উদ্ধারের পর বেশিরভাগ অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।
রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহ মো. আজাদ বলেন, ‘রেললাইনে লাশ উদ্ধারের ঘটনায় প্রথমে অপমৃত্যুর মামলা হয়। পরে অনুসন্ধান করা হয় এসব হত্যাকাণ্ড নাকি দুর্ঘটনা। হত্যাকাণ্ড হলে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘চলন্ত ট্রেনে ছিনতাইয়ের ঘটনা বর্তমানে অনেক কম। ট্রেনের ছাদে সাধারণত যাত্রীদের উঠতে দেওয়া হয় না। আর ভেতরে রেল পুলিশ দায়িত্ব পালন করে। তারপরেও মাঝে মধ্যে ছিনতাইয়ের ঘটনা ও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনা আমরা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।’
রেলওয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, রেললাইন থেকে লাশ উদ্ধারের পর ওই ঘটনা হত্যাকাণ্ড নাকি দুর্ঘটনা— তা নির্ধারণ করা কঠিন। একমাত্র শ্বাসরোধে হত্যা করা হলে বা চেতনানাশক কিছু খাইয়ে হত্যা করা হলে, তা নির্ণয় করা যায়। এছাড়া প্রত্যক্ষদর্শী ও খোয়া যাওয়া জিনিসপত্র উদ্ধারের সূত্র ধরেও কোনও মৃত্যুর ঘটনা হত্যাকাণ্ড কিনা তা নির্ধারণ করা যায়। বাকি ঘটনাগুলো ছিনতাইকারীদের হাতে হয়েছে কিনা, তা বলা অনেক কঠিন।
সর্বশেষ সফিকুল হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে রেলওয়ের কমলাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসীন ফারুক বলেন, ‘এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। আমরা তার মোবাইল কল রেকর্ডের সূত্র ধরে রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চালাচ্ছি। তিনি কি সত্যিই ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছিলেন নাকি দুর্ঘটনার শিকার, তা জানার চেষ্টা চলছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সারাদেশে চলন্ত ট্রেনে সংঘবদ্ধ কয়েকটি ছিনতাইকারী গ্রুপ ঘুরে বেড়ায়। তারা সুযোগ পেলেই সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে যাত্রীদের ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তবে এই ঘটনা বেশি ঘটে লোকাল ট্রেনে এবং ট্রেনের ছাদে। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় জেলার কমলাপুর থেকে গাজীপুর, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, বি. বাড়িয়া, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলার সান্তাহার, পার্বতীপুর এলাকায় চলাচলকারী ট্রেনগুলোতে এসব ঘটনা বেশি ঘটে।
রেল পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, আগে এ ধরনের ছিনতাই ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল তিনটি ছিনতাইকারী গ্রুপ। এই তিন গ্রুপের নেতৃত্বে ছিল জামালপুরের ল্যাংড়া জাহাঙ্গীর, টঙ্গীর কানকাটা আলামিন ও মামুন। এসব গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে আশরাফ, ট্যাক্সি রুবেল, রাসেল, মুন্না, রাব্বী উল্লেখযোগ্য। এদের কেউ কেউ বর্তমানে কারাগারে রয়েছে।
রেলপুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, পাঁচ-ছয় জনের একটি করে ছিনতাইকারী গ্রুপ ট্রেনের ছাদে ও কামরার দরজায় আসা যাত্রীদের গলায় গামছা পেঁচিয়ে টাকা-পয়সা নিয়ে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়।এ কাজে তারা সময় নেয় বড়জোর দুই থেকে তিন মিনিট।
বছরখানেক আগে গ্রেফতার হওয়া এই গ্রুপের এক সদস্য আশরাফ পুলিশকে জানায়, ছিনতাইয়ের পর টার্গেট ব্যক্তিকে নিচে ফেলে না দিলে পরবর্তীতে তাদের (ছিনতাইকারী) ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য টার্গেট ব্যক্তিকে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়াকেই নিরাপদ মনে করে সংঘবদ্ধ গ্রুপগুলো।
রেলের ভৈরব থানার ওসি আব্দুল মজিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চলন্ত ট্রেনে কয়েকটি ছিনতাইকারী গ্রুপ আগে সক্রিয় ছিল। তাদের অনেকেই গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। বর্তমানে যারা একাজে জড়িত, তাদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’
রেলওয়ে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজীপুর সদর ও কালিয়াকৈর এলাকা থেকে একসঙ্গে তিন যুবকের লাশ ও আহত অবস্থায় একজনকে উদ্ধার করা হয়েছিল। পরের বছর ১৬ অক্টোবর গাজীপুরের ধীরাশ্রম রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে আবু বকর নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত বছরের ২২ মার্চ গাজীপুরের শিমুলিয়া এলাকায় একই ধরনের ঘটনায় একজন নিহত ও দুই জন গুরুতর আহত হন। প্রতিটি ঘটনার হতাহতরা মূলত ছিনতাইকারীদের নির্মম নৃশংসতার শিকার।