গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিতে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে
![](https://dinbodalnews24.com/wp-content/uploads/2017/02/gas120170223175601.jpg)
![](https://dinbodalnews24.com/wp-content/uploads/2017/02/gas120170223175601.jpg)
দিনবদল ডেক্স: সরকার গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করায় বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রফতানিমুখী ও অভ্যন্তরীণ সবধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা কমে যাবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। বাড়বে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়। ফলে সার্বিক অর্থনীতিতেই বিরূপ প্রভাব পড়বে। এমনটাই মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) পক্ষ থেকে দুই ধাপে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়। গ্যাসের বর্ধিত মূল্য আগামী ১ মার্চ থেকে কার্যকর হবে।
বিইআরসির ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ১ মার্চ থেকে আবাসিক খাতে গ্যাসে দাম হবে দুই চুলার ক্ষেত্রে ৮০০ এবং এক চুলার ক্ষেত্রে ৭৫০ টাকা। এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে প্রতি ঘনমিটার ২ টাকা ৯৯ পয়সা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৮ টাকা ৯৮ পয়সা, সার খাতে ২ টাকা ৬৪ পয়সা, শিল্পে ৭ টাকা ২৪ পয়সা, চা বাগানে ৬ টাকা ৯৩ পয়সা, বাণিজ্যিকে ১৪ টাকা ২০ পয়সা, সিএনজিতে ৩৮ টাকা এবং গৃহস্থালিতে (মিটারভিত্তিক) ৯ টাকা ১০ পয়সা দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
আর ১ জুন থেকে আবাসিক খাতে গ্যাসে দাম হবে দুই চুলার ক্ষেত্রে ৯৫০ এবং এক চুলার ক্ষেত্রে ৯০০ টাকা। এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে প্রতি ঘনমিটার ৩ টাকা ১৬ পয়সা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৯ টাকা ৬২ পয়সা, সার খাতে ২ টাকা ৭১ পয়সা, শিল্পে ৭ টাকা ৭৬ পয়সা, চা বাগানে ৭ টাকা ৪২ পয়সা, বাণিজ্যিকে ১৭ টাকা ৪ পয়সা, সিএনজিতে ৪০ টাকা এবং গৃহস্থালিতে (মিটারভিত্তিক) ১১ টাকা ২০ পয়সা।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অর্থনীতি বেশ এগিয়ে গেছে। মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) কয়েক বছর ধরে ৬ শতাংশের ওপরে রয়েছে। চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ওপরে হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতিও বেশ নিয়ন্ত্রণে। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা ধীরগতি রয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে ব্যবসা পরিচালন ব্যয়, উৎপাদ ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে বেড়ে যাবে পণ্যের মূল্য। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। সেইসঙ্গে বিনিয়োগ ও শিল্প উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে জিডিপির প্রবৃদ্ধিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এ মুহূর্তে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা আছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। এ দাম বাড়ানোর কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। বাড়বে পণ্যের দাম। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। ভোগান্তিতে পড়বে সাধারণ মানুষ। কারণ আমরা সবসময় দেখি গ্যাসের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হুট করে সব কিছুর দাম বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়ানো হয়। বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রেও এমনটি হয়।
তিনি বলেন, বর্তমানে রফতানিতে একটি বিরূপ প্রভাব রয়েছে। চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে রফতানি আয়। গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। যদি বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে দর কসাকসি করে মূল্য বাড়াতে না পারে তাহলে রফতানি লক্ষ্যমাত্রা বাধাগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানো অবশ্যই জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। যারা সীমিত আয়ের লোক তাদের ওপর এর প্রভাব বেশি পড়বে। কারণ ১০০ টাকা বৃদ্ধি কিন্তু কম নয়। এক্ষেত্রে সরকার বিকল্প কিছু পদক্ষেপ নিতে পারতো। বিশেষ করে গ্যাস ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত ছিল। কিন্তু গ্যাস ব্যবহারে তেমন কোনো গাইডলাইন নেই। আমরা শুধু ব্যবহারই করে যাচ্ছি।
গ্যাসের এই দাম বাড়ানোর বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ জাগো নিউজকে বলেন, আমরা গ্যাসের দাম বাড়ানোর পক্ষে নয়। সরকার গ্যাসের দাম বাড়ানোয় যেসব শিল্প রফতানি করে তারা সমস্যায় পড়বে। তাদের খরচ বেড়ে যাবে। তাই এ ধরনের শিল্পের ক্ষেত্রে বাড়তি দাম না নেয়াই উচিত।
তিনি বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে রফতানিমুখী শিল্পের পাশাপাশি যেসব অভ্যন্তরীণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গ্যাস ব্যবহার করে তাদের খরচ বেড়ে যাবে। এর ফলে জিনিসপত্রের দামও বেড়ে যাবে। যার চূড়ান্ত ভুক্তভোগী হবে সাধারণ মানুষ। তাই গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষকেই বেশি ভুগতে হবে।
‘তবে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের যে আগ্রহ দেখাচ্ছেন তাতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কারণ বাংলাদেশে গ্যাসের দাম বিদেশের থেকে এখনও অনেক কম। সুতরাং গ্যসের দাম বাড়ার কারণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে না’ বলেন মাতলুব আহমেদ।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে সবধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত এবং বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। ব্যবসা করার খরচ বেড়ে যাবে। ফলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ বাড়বে। সবধরনের জিনিসের দাম বেড়ে যাবে। ফলে মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। গ্যাসের দাম ১ টাকা বাড়লে পণ্যের দাম বাড়বে ২ টাকা।
তিনি বলেন, এমন এক সময় গ্যাসের দাম বাড়ানো হলো, যখন একদিকে অ্যাপারেলের দাম বাড়ছে অন্যদিকে ব্যবসা করার খরচ বাড়ছে। গত বছর অ্যাপারেলের দাম সাড়ে ৭ শতাংশ কমেছে। এ পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে দেশের গার্মেন্টস খাত মারাত্মক চাপে পড়ে যাবে। আমাদের সক্ষমতা কমে যাবে।
তিনি আরও বলেন, গ্যাসের এই দাম বাড়ার কারণে পরিবহনের ভাড়া বেড়ে যাবে। ব্যবসায়ীদের পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে। জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসহ সবধরনের পণ্যের দাম বাড়বে।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় কার্যপরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুবিনুল হায়দার চৌধুরী বলেন, মহাজোট সরকারের গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি হীন পদক্ষেপ। এতে সাধারণ মানুষের জীবনে আরও দুর্ভোগ নেমে আনবে। এ সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
তিনি বলেন, এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এবং গাড়ি ভাড়া, বাড়ি ভাড়া আকাশছোঁয়া তার ওপর আবার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে ফেলে দেবে। গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে কয়েক হাজার কোটি টাকা জমা থাকা সত্ত্বেও এবং রাষ্ট্রীয় সব গ্যাস কোম্পানি লাভজনক অবস্থায় থাকার পরও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি দুর্নীতিকে আরও পাকাপোক্ত করবে।