উড়ে যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে
তানভীর রানা মুস্তাফিজ
আমার প্লেনে উঠতে ভালো লাগে। মনে আছে, মায়ের সঙ্গে একটা অনুষ্ঠানে যশোর যাব বলে প্রথম প্লেনে উঠি। সে এক বিশাল উত্তেজনা! তারপর প্লেনে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে কানাডার পথে। দু’তিন মাস পার হওয়ার পর দেখা গেল আমি মাইকেল মধুসূদন দত্ত হয়ে গেছি। ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে কবি যে অর্থনৈতিক টানাপড়েনের ভেতর পড়েছিলেন, আমারও সে অবস্থা। একদিকে পড়াশোনার খরচ, অন্যদিকে সংসার।
এ সময় আমার স্ত্রীর ছোট ভাই আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া থেকে সেন্ট্রাল ব্যাংক হিসেবে আবির্ভূত হলো। বলল, ‘রানা ভাই, আপনি মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনাটা করেন। মান্থলি শর্ট ফলের বিষয়টা দেখা যাবে।’ শুধু সেন্ট্রাল ব্যাংকের আশায় বসে থাকলে তো হয় না। নিজেরও কিছু করা দরকার। দেখা গেল এক কল সেন্টারে লোক নিচ্ছে। ইন্টারভিউ যে নিচ্ছে তার নাম রবার্ট। তিনি বললেন, ‘এটা সেল্স জব। তুমি কাল থেকে জয়েন করতে পার।’ সকাল ৯টা থেকে কাজ শুরু হয়। পত্রিকার নাম ‘গ্গ্নোব অ্যান্ড মেইল’। একদিন রবার্ট পাশে বসে বলল, ‘তোমার দেশ সম্পর্কে বল।’ আমি বললাম, ‘বর্ষায় ওখানে খুব সুন্দর বৃষ্টি হয়। সেই পানি কচুর পাতার ওপর পড়লে এদিক থেকে ওদিক ছুটতে থাকে। কচুর পাতার বিষয়টা অবশ্য তুমি ঠিক বুঝবে না। এখানে কচুর পাতা নেই। এখনও কান পাতলে বৃষ্টির সেই ঝিরঝির শব্দটা শুনতে পাই।’
রবার্ট পকেটের মানিব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে আমাকে বলল, ‘এই যে কার্ডটা দেখছ, এর নাম হলো এয়ার মাইল কার্ড। আজই অনলাইনে অ্যাপ্লাই করে দাও। ওরাই বিনা পয়সায় তোমার বাড়িতে পেঁৗছে দেবে। তারপর যখনই কিছু কিনবে এই কার্ডটা সোয়াপ করবে। এক সময় দেখবে তোমার দেশে বেড়াতে যাওয়ার মতো এয়ার মাইল জমা হয়ে গেছে।’ এয়ার মাইলের বিষয়টা আমার জন্য নতুন। ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম, ১৯৮৮ সালে যুক্তরাজ্যে ‘স্যার কিথ মিলস’ প্রথম এয়ার মাইলের ধারণাটি নিয়ে আসেন। কানাডা, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এয়ার মাইলের কার্যক্রম আছে।
জিনিসপত্র কিনে কার্ডের ভেতর এয়ার মাইল ভরে ফেলা যায়- এটা আমার জন্য অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সেদিনই আমি কার্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করে দিলাম। সপ্তাহখানেকের মধ্যে মেইল বক্সে এয়ার মাইল কার্ড এসে উপস্থিত। কার্ড হাতে নিয়ে মনে হলো, দেশে কত মানুষের সারাজীবনে প্লেনে চড়া হয় না। আচ্ছা, এমন করলে কেমন হয়? মোবাইল ফোনে প্রতিবার রিচার্জ করলে দুই এয়ার মাইল পাওয়া যাবে। ঢাকা থেকে কক্সবাজারের প্লেনে দূরত্ব ২৯৮ কিলোমিটার। তাহলে ফোন ক’বার রিচার্জ করতে হবে?
ভাবুন তো, মা-বাবা, নাতি-নাতনি, ছেলে, ছেলের বউ নিয়ে প্লেনে কক্সবাজার যাচ্ছেন। তাদের সবার চোখেমুখে প্রথমবারের মতো প্লেনে ওঠার আনন্দ। হয়তো বাবা ছেলেকে প্রশ্ন করলেন- ‘এই বাবলু, এখানে কি খাওয়ার পর পানের ব্যবস্থা আছে?’ এমন একটা দৃশ্য কি টাকা দিয়ে কেনা যায়! তারপর মাটি ছেড়ে প্লেনটা অনেক উঁচুতে উঠে যাবে।
জানালার বাইরে ছোট ছোট মানুষ আর ঘরবাড়ি দেখে তাদেরও কারও কারও আমার মতো মনে হবে- ‘এই তাহলে আমাদের পৃথিবী, আহারে এর জন্যই এত কিছু!’
য়টরন্টো, কানাডা থেকে
tanveer_mustafiz@yahoo.com