“ইসলাম শান্তির ধর্ম, সৌহাদ্যের ধর্ম, জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করে না : প্রধানমন্ত্রী

0

pm_hasina_1803162017013012120170131150708

দিনবদল ডেক্স: সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং সংঘাতের বিস্তারের প্রেক্ষাপটে অস্ত্র বিক্রেতা দেশগুলোর দিকে আঙুল তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বৃহস্পতিবার ঢাকায় ইমামদের এক সম্মেলনে তিনি বলেন, যেসব দেশ মুসলিম অধ্যুষিত, সেখানেই ‘মারামারি, কাটাকাটি, সেখানেই বোমাবাজি, খুনখারাবি’ হচ্ছে। সেখানেই অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে।

“কিন্তু, এই অস্ত্রটা তৈরি করে কারা? আর লাভবান কারা হয়? রণক্ষেত্র বানাচ্ছে আমাদের মুসলমাদের জায়গাগুলো। রক্ত যাচ্ছে মুসলমানদের। আর ওই অস্ত্র তৈরি করে আর বিক্রি করে কারা লাভবান হচ্ছে? সেটা আপনারা একটু চিন্তা করে দেখবেন।”

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় ইমাম সম্মেলনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি শিশু-কিশোর সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে সনদ ও পুরস্কার বিতরণ করেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, “দুর্ভাগ্য ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেও কিছু লোক… এই জঙ্গিবাদী আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বলেই আমাদের পবিত্র ধর্মটা আজ মানুষের কাছে হেয় হচ্ছে। আজকে আন্তর্জাতিকভাবে এই ধর্মের মান-সম্মান ক্ষুণ্ন করছে, অন্যের চোখে এই ধর্মকে খাটো করে দিচ্ছে, ছোট করে দিচ্ছে।”

ইসলাম ধর্মের শেষ বিচারে বিশ্বাসের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, “শেষ বিচার আল্লাহ রাব্বুল আলামিন করবেন। কেউ যদি সৎ পথে থাকেন, সে বিচার তিনি করবেন। কেউ যদি ভুল পথে থাকে, সে বিচার তিনি করবেন। সেই বিশ্বাসটা কেন আমরা রাখতে পারি না। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস হারিয়ে কেন নিজেরাই হাতে তুলে নেই… মানুষ খুন করা আর সেটা আবার ধর্মের নামে..”

সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আলেমদের আরও সোচ্চার হওয়ার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী।

“ইসলাম যে শান্তির ধর্ম, সৌহাদ্যের ধর্ম, ইসলাম যে জঙ্গিবাদে বিশ্বাস করে না- এই বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে মানুষকে বোঝাবেন। কারণ আপনাদের কথা মানুষ শুনবে, মানুষ নেবে।”

পাশাপাশি মাদকাসক্তি ও জঙ্গিবাদ থেকে শিশু ও যুব সমাজকে রক্ষায় ইমাম ও আলেমদের দায়িত্বের কথাও শেখ হাসিনা মনে করিয়ে দেন।

“আপনারা মানুষকে ঠিকমতো বোঝালে আমরা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ চিরতরে দূর করতে পারব।… আমরা পুরো বিশ্বকে দেখাতে চাই, বাংলাদেশই পারবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে সত্যিকার ইসলাম ধর্মের মূল মর্মবাণী মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে।”

প্রধানমন্ত্রী সূরা কাফিরুনের উল্লেখ করে বলেন, “ইসলাম শান্তির ধর্ম, সৌহার্দের ধর্ম, ভাতৃত্বের ধর্ম। যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে- এটা আমাদের পবিত্র কোরআন শরীফে বলা আছে।”

ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি আলেম-ওলামাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও সম্পৃক্ত করতে সরকারের প্রাথমিক পরিকল্পনার রয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

“অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যাতে আয় বাড়ানো যায়, এজন্য শুধুমাত্র আলেম-ওলামাগণের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে এমন একটি অর্থনৈতিক জোন তৈরি করার চিন্তা-ভাবনাও আমাদের রয়েছে।”

বিশ্বে হালাল খাদ্যের চাহিদা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “হালাল খাদ্য ও পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে সত্যিকারভাবে হালাল খাদ্য তৈরি হচ্ছে কি না, সেগুলো পর্যবেক্ষণের জন্যও আমি মনে করি ইসলামিক ফাউন্ডেশন কিছু ব্যবস্থা নিতে পারেন। এতে আলেম ওলামাদের কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবে।”

ইসলামের কল্যাণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে তুলে ধরেন।

১৯৭৫ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু। দেশে প্রায় ৩ লাখ মসজিদে ৬ লাখ ইমাম ও মুয়াজ্জিন কর্মরত আছেন। প্রতিষ্ঠানটি ইমামদের ইসলামী বুনিয়াদি শিক্ষার পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। একলাখ ৮০ হাজার ৪২৯ জন আলেম এ পর্যন্ত ইসলামের মৌলিক বিষয়সহ আর্থ-সামাজিক, জনসচেতনতা এবং কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বল্প ব্যয়ে হজ করার জন্য বঙ্গবন্ধু ‘হিজবুল বাহার’ নামে একটি জাহাজ ক্রয় করেছিলেন, যেটাকে পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নিয়ে প্রমোদতরী বানায়।

ধর্ম শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “আমরা শিক্ষাটাকে আরও সার্বজনীন করতে চাই, উন্নত করতে চাই। কারণ, আমি নিজে বিশ্বাস করি যে, শিক্ষাটা পূর্ণাঙ্গ হবে তখনই, যখন পার্থিব জগতের শিক্ষার সাথে সাথে ধর্মীয় শিক্ষাটাও সবাই গ্রহণ করতে পারবে। শিক্ষা নীতিমালায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।”

এসময় আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশে ‘দারুল আরকাম’ নামে মসজিদভিত্তিক বিশেষায়িত প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছি।”

হজের সার্বিক কার্যক্রম উন্নত প্রযুক্তির আওতায় আনার কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জেদ্দা হজ টার্মিনালে প্লাজা ভাড়া নেওয়ায় হাজীদের দুর্ভোগ অনেকাংশে কমে গেছে।”

প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় মসজিদ নির্মাণের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ইতিমধ্যে, আমি যখন সৌদি আরব গিয়েছিলাম.. বাদশাহর সাথে আমরা দেখা হয়। আমার মনের একটা ইচ্ছা আছে যে, আমরা সমস্ত উপজেলায় ও জেলায় মডেল মসজিদ এবং ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করব। যেখান থেকে ইসলামের সঠিক তথ্য ও ইসলাম সম্পর্কে মানুষ জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। স্থানীয় ইমাম ও মোয়াজ্জিনদের প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে, তাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে। এই মসজিদ কমপ্লেক্সে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ভবনসহ মহিলাদের জন্য পৃথক নামাজকক্ষ, মুসলিম পর্যটক ও মেহমানদের বিশ্রামাগার থাকবে। এখানে হজযাত্রীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ইসলামী লাইব্রেরি ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত থাকবে।”

তিনি বলেন, “মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্পে ১ হাজার ৫০৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছি। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৭৬ হাজার ৬৬০ জন আলেম-ওলামার কর্মসংস্থান হয়েছে। ৯৬ লাখ ১৬ হাজার শিক্ষার্থী মসজিদভিত্তিক শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪ লাখ ৫০ হাজার কুরআনুল করীম বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে।”

একহাজারেরও বেশি মাদরাসার একাডেমিক ভবন নির্মাণ করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “৮০টি মাদরাসায় অনার্স কোর্স চালু করেছি। আমরা জাতীয় শিক্ষা নীতিতে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করেছি।”

মসজিদগুলোকে ইসলামী জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২৭ হাজার ৮৩২টি মসজিদ পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে বলেও প্রধানমন্ত্রী বলেন।

তিনি বলেন, “ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম ডিজিটালে রূপান্তরিত করা হয়েছে। একটি ডিজিটাল আর্কাইভ করা হয়েছে। দেশের সকল মসজিদ, মাদরাসা, খানকা ও দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের তথ্যসম্বলিত একটি ডাটাবেস তৈরির কাজ চলছে। প্রতিটি জায়গার হিসাবে যাতে হাতের মুঠোয় থাকবে।”

ইমাম-মুয়াজ্জিন কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে সুদমুক্ত ঋণ দেওয়ার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।

এর আগে প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ ও ২০১৪ সালে শ্রেষ্ঠ ইমাম ও জাতীয় শিশু-কিশোর সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন।

ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি বি এইচ হারুন এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক শামীম মোহাম্মদ আফজালও উপস্থিত ছিলেন।

জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ ইমামের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন মাওলানা ওহাবউল্লাহ এরশাদ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন ধর্ম সচিব মো. আব্দুল জলিল।

অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় সংগীতের পর ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়। এরপর হামদ, নাত ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন সংগীত শোনানো হয়।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *