অসম্পূর্ণ তথ্যে আটকে গেছে স্মার্টকার্ড ছাপা
দিনবদল ডেক্স: আশঙ্কাই সত্য হলো। অসম্পূর্ণ ও ভুল তথ্যে ভরা স্মার্টকার্ড তড়িঘড়ি করে ছাপানো শুরু হলেও এখন তা আটকে গেছে। জাতীয় তথ্যভাণ্ডারে নাগরিকদের সংরক্ষিত তথ্য যাচাই-বাছাই ও সংশোধনের সুযোগ না দিয়ে কার্ড ছাপা শুরু করায় এমন পরিস্থিতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কার্ড ছাপা বন্ধ রেখে আবারও তথ্য যাচাইয়ে মাঠে নামতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
২০১১ সালের আগে যারা ছবিসহ ভোটার তালিকায় নাম উঠিয়েছেন তাদের তথ্য সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) কার্যালয়ের সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। তিনি আরও জানান, চলতি সপ্তাহে এ-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। ২০১১ সালের আগে যারা ভোটার হয়েছেন তারা নিজেদের দেওয়া তথ্য সংশোধনের সুযোগ পাবেন।
ইসি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতোই তথ্য সংশোধন না করে স্মার্টকার্ড ছাপার কাজ শুরু করা হয়েছিল। গত বছরের মার্চে কার্ড ছাপা শুরু করে ইসি। অক্টোবরে স্মার্টকার্ড বিতরণ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয়। এ পর্যন্ত ছাপা হয়েছে মাত্র ৮০ লাখ কার্ড। বিতরণ হয়নি তার অর্ধেকও। এর মধ্যে বিতরণ করা কার্ডে ভুলও ধরা পড়ছে। রাজধানীর মিরপুর থানা এলাকাতেই ২৯ হাজারের মতো ভোটারের তথ্য অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। অন্যান্য এলাকাতেও প্রায় একই অবস্থা। দেশের ১০ কোটিরও বেশি ভোটারের মধ্যে নয় কোটি ভোটারের কার্ড ছাপানোর কথা ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে। এ সময়ের পরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।
ইসি সচিব আবদুল্লাহ গতকাল সমকালকে বলেন, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ৯ কোটি ভোটারের জন্য স্মার্টকার্ড ছাপা সম্ভব হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতিতে মনে হচ্ছে আগামী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সময় লাগবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সদ্য বিদায়ী কাজী রকিব উদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশন তড়িঘড়ি করে স্মার্টকার্ড ছাপার কাজ শুরু করায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। স্মার্টকার্ডে নাগরিকের নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম, পেশা, স্থায়ী ঠিকানা, বর্তমান ঠিকানা, জন্মতারিখ, রক্তের গ্রুপ, লিঙ্গ, বৈবাহিক অবস্থা, দৃশ্যমান শনাক্তকরণ চিহ্ন, ধর্ম, জন্মস্থান, জন্মনিবন্ধন সনদ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ড্রাইভিং লাইসেন্স নম্বর, পাসপোর্ট নম্বর, আয়কর সনদ নম্বর, টেলিফোন নম্বর, মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, স্বামী বা স্ত্রীর নাম ও পরিচয়পত্র নম্বর, প্রতিবন্ধী হলে সেই তথ্য স্মার্টকার্ডে থাকার কথা রয়েছে। ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত সরকারের আমলে দেশে ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়। ওই সময়ে প্রথমবারের মতো ভোটার তালিকায় নাম ওঠাতে গিয়ে অনেক নাগরিকের তথ্য সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। তখন ভোটার তালিকায় যাতে ভুয়া ভোটার ঢুকতে না পারে সে বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। পরে এ তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই জাতীয় পরিচয়পত্র বিতরণ শুরু হয়। বিগত বছরগুলোতে নানা হয়রানির শিকার হয়ে সীমিত সংখ্যক নাগরিক ওই তথ্য সংশোধনের সুযোগ পেলেও বাকিদের অনেক তথ্য অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
ইসি-সংশ্লিষ্টদের হিসাব অনুযায়ী, জাতীয় তথ্যভা ারে কমপক্ষে আড়াই কোটি ভোটারের তথ্যে বড় ধরনের ভুল রয়েছে। অনেকে বলছেন, এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কেননা, ২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো দেশে ছবিসহ ভোটার তালিকার প্রচলন হয়। প্রশিক্ষিত জনবল ও অভিজ্ঞতা না থাকায় ওই সময়ের এনআইডি কার্ডধারীদের তথ্যে গুরুতর ত্রুটি রয়ে যায়। তবে ত্রুটিযুক্ত কার্ডধারীর প্রকৃত সংখ্যা কত সে হিসাব নেই ইসির কাছে। এ ছাড়া ওই সময়ে যারা ভোটার হয়েছেন, গত আট বছরে তাদের ব্যক্তিগত তথ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
তবে গত বছর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও পেনশনভোগীদের অর্থ তোলার ক্ষেত্রে আইডি কার্ড জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করায় এসব কার্ডের তথ্য সংশোধন করা হয়েছিল। তখন দেশের প্রায় ১২ লাখ সরকারি কর্মচারীর মধ্যে তিন লাখের বেশি আইডি কার্ডে ভুল ধরা পড়েছে। সেই হিসাবে ১০ কোটি ভোটারের মধ্যে আড়াই কোটির আইডি কার্ডে ভুল রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অন্য সাধারণ নাগরিকদের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন এবং তাদের সবারই শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ রয়েছে। সাধারণ নাগরিকদের আইডিতে এ ধরনের ভুল আরও বেশি থাকা স্বাভাবিক নয়।
ইসি সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ অবশ্য জানিয়েছেন, প্রকল্পের নির্ধারিত সময় অনুযায়ী আগামী ১ মার্চ চট্টগ্রামে এবং মার্চের শেষের দিকে রাজশাহীতে স্মার্টকার্ড বিতরণের পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়াও এপ্রিল ও মে মাসের মধ্যে খুলনা, বরিশাল, সিলেটসহ সব বিভাগীয় শহরে কার্ড বিতরণ শুরুর চেষ্টা চলছে।
ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ১০ ডিজিটের এই উন্নতমানের জাতীয় পরিচয়পত্র স্মার্টকার্ড ব্যবহার করে আয়করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) প্রাপ্তি, ড্রাইভিং লাইসেন্স নম্বর প্রাপ্তি ও নবায়ন, পাসপোর্ট প্রাপ্তি ও নবায়ন, চাকরির জন্য আবেদন, স্থাবর সম্পত্তি কেনা-বেচা, ব্যাংক হিসাব খোলা ও ঋণপ্রাপ্তি, সরকারি বিভিন্ন ভাতা উত্তোলন, সরকারি ভর্তুকি, সাহায্য, সহায়তা প্রাপ্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, বিমানবন্দরে ই-গেটের মাধ্যমে আগমন ও বহির্গমন সুবিধা, শেয়ার আবেদন ও বিও অ?্যাকাউন্ট খোলা, ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তি, যানবাহন রেজিস্টেশন, বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রেশন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সংযোগ গ্রহণ, মোবাইল ও টেলিফোন সংযোগ গ্রহণ, বিভিন্ন ধরনের ই-টিকেটিং, সিকিউরড ওয়েব লগ ইন, ই-ফরম পূরণে নাগরিকের সঠিক ও নির্ভুল তথ্য পাওয়া যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদ্য নিযুক্ত নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদৎ হোসেন চৌধুরী বলেন, নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পরে এ বিষয়ে এখনও কোনো আলোচনার সুযোগ হয়নি। একটি মাত্র কমিশন সভা হয়েছে, এতে এনআইডির কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়নি।