শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত দিল্লি
দিনবদল ডেক্স: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত দিল্লি। ৭ বছর পর এক ঐতিহাসিক সফরে আসছেন তিনি। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে তার সফরকে ‘অতীব গুরুত্বপূর্ণ’ বলে আখ্যায়িত করেছিল ভারত সরকার ও গণমাধ্যম। এবারের সফর শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, ‘ঐতিহাসিক’ বলেই মনে করছে দিল্লি ও ঢাকা। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হতে পারে, তার মোটামুটি একটি তালিকাও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের রোডম্যাপ এবং গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখার যৌথ কারিগরি ব্যবস্থাপনা। সমঝোতার মধ্যে রয়েছে এই প্রথম ভারত-বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং প্রতিরক্ষা খাতের জন্য পাঁচশ’ মিলিয়ন ডলারসহ মোট পাঁচ বিলিয়ন নতুন ঋণ। হাইটেক সহযোগিতার মধ্যে রয়েছে_ তথ্যপ্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা, প্রতিরক্ষা ও অসামরিক পরমাণু সহযোগিতা। এ বিষয়ে একটি সুসংহত সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর হবে। এ ছাড়া যোগাযোগের ক্ষেত্রে সমুদ্রপথ ছাড়াও জলপথে পরিবহনের নতুন সিদ্ধান্ত ঘোষিত হবে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর যেসব রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো চালু করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা হবে। প্রধানমন্ত্রী মোদি ও প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাধিকাপুর-বিরল লাইন ও কলকাতা-খুলনা ট্রেন চালু করবেন। যোগাযোগের ক্ষেত্রে আপাতত বিবিআইএনের পরিবর্তে বাংলাদেশ-নেপাল-ভারত রেল ও সড়ক যোগাযোগ তৈরি করার প্রস্তাব দেবে ভারত। যেহেতু ভুটান পার্লামেন্ট এখনও বিবিআইএন প্রজেক্টে সম্মতি দেয়নি।
প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে হায়দরাবাদ হাউসে অনুষ্ঠিত প্রথম একান্ত বৈঠকে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির জটিলতা অবসানে নয়া রোডম্যাপ তৈরি হবে বলে নয়াদিল্লীর একটি সূত্র জানিয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি স্বাক্ষর না হলেও আগামী দিনে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরির জন্য যৌথ ঘোষণাপত্রে উল্লেখ থাকবে। এতদিন যৌথ ঘোষণাপত্রে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে যে অনুচ্ছেদ উলি্লখিত হতো, তা সংশোধন করে নয়া অনুচ্ছেদ লেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী মোদি কেন্দ্রের পানিসম্পদমন্ত্রী উমা ভারতের সঙ্গে বৈঠক করে এ বিষয়ে বিশেষ নোট প্রস্তুত করতে বলেছেন। ফলে ৮ এপ্রিল দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে প্রতিনিধি স্তরের বৈঠকের সময়ে এ বিষয়ে উভয় দেশের পানিমন্ত্রী আলোচনা করে মতবিনিময় করবেন এবং ঘোষণাও হবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ পর্যন্ত এ সফর নিয়ে দিলি্লর আমন্ত্রণ গ্রহণ সম্পর্কে নীরব। তিনি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির নৈশভোজে যোগ দেবেন কি-না তাও কেউ জানেন না। তিস্তা নদী ব্যতীত গঙ্গা নদীর ওপর তিন বিলিয়ন ডলারের ব্যারাজ নির্মাণের জন্য যৌথ উদ্যোগ ঘোষিত হবে। এ উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে একটি কারিগরি উপকমিটি, যারা প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা এবং তার প্রতিক্রিয়ার সমীক্ষা করবে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতার মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রেখেই করা হবে বলে সরকারি সূত্র জানিয়েছে। ভারতের দিক থেকে মূল লক্ষ্য বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত নিরাপত্তা। বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ উপকূল বরাবর বাংলাদেশের উপকূল বাহিনীর প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও প্রশিক্ষণের জন্য ভারত সহযোগিতা করবে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দুটি চুক্তি ও সাতটি সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর হতে পারে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘সম্প্রীতি’ নামে যৌথ সামরিক মহড়ার বর্তমান ব্যবস্থাপনা সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তাকে আরও উন্নত করার লক্ষ্যেই ভারত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি করতে চায়। এ ক্ষেত্রে সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর হলেও ভারতের আপত্তি নেই। কেননা ভারত সরকারের এক পদস্থ কর্তার মতে, চুক্তি বা সমঝোতা যাই হোক তাতে যদি বিষয়গুলো একই হয়, তাহলে এ নিয়ে বিতর্ক অহেতুক।
বিবিআইএন সমঝোতার ভিত্তিতে ভারত করিমগঞ্জ (আসাম)-শাহবাজপুর (বাংলাদেশ), আগরতলা-আখাউড়া, সাবরুম (ত্রিপুরা)-চট্টগ্রাম বন্দর রেল যোগাযোগ তৈরি করবে নয়া এলওসি থেকে। বাণিজ্য ও পর্যটন বৃদ্ধির জন্য গৌহাটি, ঢাকা ও সিলেটকে আঞ্চলিক বিমান ও রেল মানচিত্রে আনার প্রস্তাব রয়েছে। তবে ভারতের একটি দূরগামী প্রভাব সৃষ্টিকারী রেল যোগাযোগ তৈরির বিষয়ে বাংলাদেশকে অবগত করবে দিল্লি। সেটি হলো বাংলাদেশে-ভারত-পাকিস্তান-ইরান-তুর্কি রেল যোগাযোগ। এ বিষয়ে পাকিস্তানের সম্মতির আগেই ভারত বাংলাদেশের মনোভাব জানতে চায়। বাংলাদেশ এ মুহূর্তে ঢাকা-চট্টগ্রাম ব্রডগেজ লাইন নির্মাণ করছে। এই লাইন সম্পূর্ণ হলে ভবিষ্যতে ভারতের উত্তর-পূর্ব থেকে রেলপথে ভায়া বাংলাদেশ সরাসরি কলকাতা আসা যাবে। মূলত ভারতের লক্ষ্য উত্তর-পূর্বকে বাংলাদেশের মাধ্যমে মূল ভারতীয় ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা।
বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্য বাড়াতে বর্তমানের অতিরিক্ত কাউন্টার ভেইলিং ডিউটি কম করতে পারে ভারত। বিশেষ করে পাটের ক্ষেত্রে এই শুল্ক হ্রাস করার বিশেষ ঘোষণা হতে পারে। তেমনি ভারত-বাংলাদেশ যৌথভাবে পাট রফতানির ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিয়ে বিশ্ববাজার দখল করতে পারে। এ ছাড়া তুলা সরবরাহ করার বিষয়েও ভারত সরকার বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করবে। বাণিজ্যিক ঘাটতি কমানোর জন্য ভারত চাইবে মংলা ও ভেড়ামারাতে বিশেষ আর্থিক অঞ্চলে ভারতীয় শিল্পপতিদের বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বিশেষ সুবিধা। ভারত চাইছে এসব পণ্যে মেক ইন ইন্ডিয়া ছাপ দেওয়া। তাতে বাংলাদেশ রাজি নয়।
এ ছাড়া সন্ত্রাসবাদ দমনে যৌথ সহযোগিতাকে দৃঢ় করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা হবে। চুক্তি ও সহযোগিতার মধ্যে রয়েছে, সাতটি জাহাজ পরিবহন সংক্রান্ত, চারটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে, বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে তিনটি নয়া চুক্তি, চারটি শিক্ষা ক্ষেত্রে, স্বাস্থ্য, আইসিটি, বাণিজ্য ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর ওপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ যৌথ উদ্যোগে, মুক্তিযুদ্ধের ওপর তথ্যচিত্র যৌথ উদ্যোগ, বাংলাদেশ টেলিভিশনের কর্মসূচি প্রসার ভারতীতে প্রদর্শন এবং বাংলাদেশের বেতার ও আকাশবাণীর যৌথ অনুষ্ঠান সম্প্রচার।