সরকারি চাকরিজীবীরা যেভাবে পাবে গৃহঋণ
সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ২০১৮ সালে গৃহঋণ সুবিধা চালু করে সরকার। শুরুর দিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীরা এবং বিচারকরা এর বাইরে থাকলেও পরে গৃহঋণ সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
গৃহঋণ নীতিমালার আওতায় একজন সরকারি চাকরিজীবী সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকা এবং সর্বনিম্ন ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবেন। ঋণের বিপরীতে সুদের ওপর সুদ অর্থাত্ চক্রবৃদ্ধি সুদ নেওয়া হবে না। কোনো প্রসেসিং ফি বা আগাম ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কোনো অতিরিক্ত ফি দিতে হবে না।
ঋণ পরিশোধের মেয়াদকাল সর্বোচ্চ ২০ বছর। সরকারি তফসিলি ব্যাংক এবং বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফিন্যান্স করপোরেশন বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে। গৃহনির্মাণ ঋণ নেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৫৬ বছর করা হয়েছে। চাকরি স্থায়ী হওয়ার পাঁচ বছর পর থেকে সরকারি চাকরিজীবীরা এই ঋণ পাওয়ার যোগ্য হবেন। আর ঋণের সুদ হার হবে ৯ শতাংশ।
কারা কত পাবেন
জাতীয় বেতনকাঠামোর পঞ্চম থেকে প্রথম গ্রেডে বেতন-ভাতা পাওয়া সরকারি কর্মচারীরা ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশন ও বিভাগীয় সদরে বাড়ি তৈরিতে ঋণ পাবেন ৭৫ লাখ টাকা। জেলা সদরে বাড়ি তৈরি বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য পাবেন ৬০ লাখ টাকা এবং অন্যান্য এলাকায় ৫০ লাখ টাকা।
নবম থেকে ষষ্ঠ ধাপে বেতন-ভাতা পাওয়া কর্মচারীরা ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশন ও বিভাগীয় সদর এলাকার জন্য ৬৫ লাখ টাকা, জেলা সদরে ৫৫ লাখ টাকা ও অন্যান্য এলাকার জন্য ৪৫ লাখ টাকা ঋণ পাবেন। দশম থেকে ত্রয়োদশ ধাপের কর্মচারীরা ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশন ও বিভাগীয় সদরের জন্য ৫৫ লাখ, জেলা সদরে ৪০ লাখ এবং অন্যান্য এলাকার জন্য ৩০ লাখ টাকা ঋণ পাবেন।
চতুর্দশ থেকে সপ্তদশ ধাপের কর্মচারীরা ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশন ও বিভাগীয় সদরে ৪০ লাখ, জেলা সদরে ৩০ লাখ ও অন্যান্য এলাকার জন্য ২৫ লাখ টাকা ঋণ পাবেন। অষ্টাদশ থেকে বিংশতম ধাপের কর্মচারীরা পাবেন ঢাকাসহ সিটি করপোরেশন ও বিভাগীয় সদরের জন্য ৩০ লাখ টাকা, জেলা সদরে ২৫ লাখ এবং অন্যান্য এলাকার জন্য ২০ লাখ টাকা ঋণ।
গৃহঋণে যত সুবিধা
গৃহঋণের সুদ হার হবে ৯ শতাংশ। এর মধ্যে ঋণগ্রহীতা দেবে ৫ শতাংশ। আর বাকি ৪ শতাংশ সরকার ভতুর্কি দেবে। গৃহনির্মাণ কাজের ওপর ভিত্তি করে মঞ্জুরীকৃত ঋণ সর্বোচ্চ চারটি কিস্তিতে বিতরণ করা হবে। আর রেডি ফ্ল্যাট অথবা জমিসহ তৈরি বাড়ির কেনার ক্ষেত্রে সব ঋণ এক কিস্তিতে দেওয়া যাবে। অনিবার্য কারণবশত মাসিক কিস্তি পরিশোধে দেরি হলে ওই দেরির জন্য আরোপযোগ্য সুদ শেষ কিস্তির সঙ্গে যুক্ত হবে। এ ছাড়া গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে প্রথম কিস্তির ঋণের অর্থ প্রাপ্তির সর্বোচ্চ এক বছর পর এবং ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে ঋণের অর্থ প্রাপ্তির সর্বোচ্চ ছয় মাস পর ঋণগ্রহীতার মাসিক ঋণ আরম্ভ হবে। এ ছাড়া ঋণের কিস্তি পরিশোধের উপায় হিসেবে বাসা ভাড়াকে ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া যায় কি না তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে সরকার।
ঋণ পেতে যা যা লাগবে
ঋণ পাওয়ার জন্য প্রাইভেট প্লটের জন্য আবেদনপত্রের সঙ্গে বিভিন্ন দলিল জমা দিতে হবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—জমির মূল মালিকানা দলিল; এসএ/আরএস রেকর্ডীয় মালিক থেকে মালিকানা স্বত্বের প্রয়োজনীয় ধারাবাহিক দলিল; সিএস, এসএ, আরএস, বিএস এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সিটি জরিপ খতিয়ান জাবেদা নকল; জেলা/সাবরেজিস্ট্রি অফিস কর্তৃক ইস্যু করা ১২ বছরের নির্দায় সনদ (এনইসি)। আর ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে জমা দিতে হবে রেজিস্ট্রি করা বায়নাচুক্তি এবং ফ্ল্যাটের মালিকানা দলিল (বন্ধক দেওয়ার আগে)।
সরকারি/লিজ প্লটের জন্য ঋণ আবেদনের সঙ্গে প্লট বরাদ্দপত্রের ফটোকপি, দখল হস্তান্তরপত্রের ফটোকপি, মূল লিজের দলিল ও বায়না দলিলের ফটোকপি, ফ্ল্যাট ক্রয়ের রেজিস্ট্রি করা বায়নাচুক্তি, ফ্ল্যাটের বরাদ্দপত্র এবং ফ্ল্যাটের মালিকানা দলিল (বন্ধক দেওয়ার আগে)।
এ ছাড়া উভয় ক্ষেত্রে ঋণ আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হবে নামজারি খতিয়ানের জাবেদা নকল, হাল সনের খাজনা রসিদ, জমির মালিক কর্তৃক ডেভেলপারের দেওয়া রেজিস্ট্রি করা আমমোক্তারনামা দলিল, জমির মালিক এবং ডেভেলপারের সঙ্গে রেজিস্ট্রি করা ফ্ল্যাট বণ্টনের চুক্তিপত্র, অনুমোদিত নকশার ফটোকপি, ফ্ল্যাটের মাটি পরীক্ষার রিপোর্টের ফটোকপি, সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ধারিত ছকে ইমারতের কাঠামো নকশার ফটোকপি ও ভারবহন সনদ, ডেভেলপার কম্পানির সঙ্ঘস্মারক, সঙ্ঘবিধি ও রিহ্যাবের নিবন্ধন সনদের সত্যায়িত ফটোকপি, ডিজাইন মোতাবেক কাজ করার ব্যাপারে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের দেওয়া আন্ডারটেকিং, অন্য কোনো ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ নেই মর্মে ডেভেলপারের দেওয়া স্ট্যাম্প পেপারে ঘোষণাপত্র, আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্রের সত্যায়িত কপি, বেতনের সনদপত্র, সত্যায়িত ছবি ও সই। ঋণ নেওয়ার জন্য সরকারের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান মনোনীত করার আগে অর্থ বিভাগের গৃহঋণ সেলের অনুমতি নিতে হবে।
যাঁরা ঋণ পাবেন না
কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু এবং দুর্নীতি মামলার ক্ষেত্রে চার্জশিট দাখিল হলে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তিনি ঋণ গ্রহণের যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। সরকারি চাকরিতে চুক্তিভিত্তিক, খণ্ডকালীন ও অস্থায়ী ভিত্তিতে নিযুক্ত কোনো কর্মচারী ঋণ পাওয়ার যোগ্য হবেন না।
কেমন সাড়া পেল গৃহঋণ কার্যক্রম
গৃহঋণে এখন পর্যন্ত আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। এ পর্যন্ত মাত্র ৩০০ সরকারি চাকুরে গৃহনির্মাণ ঋণের সুবিধা নিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি আবেদন এবং ঋণ পেয়েছেন অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা। তারপরই আছেন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা। তাঁদের বেশির ভাগই আবার সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকার জন্য আবেদন করেছেন। বাকি যাঁরা আবেদন করেছেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদন এসেছে ৬৫ লাখ টাকার জন্য। আবার ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারা যতটা এগিয়ে, ঠিক ততটাই পিছিয়ে আছেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা। তবে কিছুসংখ্যক নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ঋণের জন্য আবদেন করেছেন। আর গৃহনির্মাণ ঋণের জন্য আবেদনের সংখ্যা যত তার থেকেও ঢের বেশি বাদ পড়ার সংখ্যা। ভুলভাবে আবেদন করার খেসারত হিসেবে বাদ দেওয়া হচ্ছে অনেক কর্মকর্তার আবেদন।
এ খাতে সরকারের খরচ কত হবে
অর্থ বিভাগের হিসাব বলছে, ১৪ লাখ সরকারি চাকরিজীবীর গৃহনির্মাণ ঋণের সুবিধা দেওয়ার কারণে এ খাতে এক হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির প্রয়োজন পড়বে। পাশাপাশি প্রায় দেড় হাজার বিচারক এর আওতায় আছেন। এবার নতুন করে যোগ হচ্ছেন ১৪ হাজার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ফলে ভর্তুকির অঙ্কটা দেড় হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে।