‘আওয়ামী লীগের শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত’ : প্রধানমন্ত্রী
বিশেষ প্রতিনিধি:
‘আওয়ামী লীগের শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত’ বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের শেকড় তৃণমূলের অনেক গভীরে প্রোথিত। সংগঠনের ক্ষতি কেউ করতে পারেনি। কারণ আওয়ামী লীগ টিকে আছে তৃণমূলের নেতাকর্মী অর্থাৎ তার শেকড়ের শক্তি অনেক বেশি। এখন সেটা যদি কারও চক্ষুশূল বা মনোব্যথা হয়, আমাদের কিছু বলার নেই। জনগণের সমর্থনেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে তাদের কল্যাণে ও দেশকে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছে। যদি শহীদের তালিকা দেখেন, দেশের জন্য একটি দল (আওয়ামী লীগের) হিসেবে এত জীবন অন্য কেউ দেয়নি।’
গতকাল ৩ নভেম্বর মঙ্গলবার জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যোগ দিয়ে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন তিনি।
নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের কঠোর সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘কারোর দয়া বা দাক্ষিণ্যে নয়, আওয়ামী লীগ জনগণের সমর্থন নিয়েই চারবার ক্ষমতায় থেকে দেশের সেবা করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ জনগণের কল্যাণে ও দেশের উন্নয়নে কাজ করে বলেই ক্ষমতায় টিকে আছে। যারা ক্ষমতায় থেকে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ সৃষ্টি ও মানুষ হত্যা করে, দেশের কল্যাণ করতে পারে না, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীর হাতে যে দলের জন্ম তাদের (বিএনপি) কেন দেশের জনগণ ভোট দেবে?’
তিনি বলেন, ‘২০০৮ সালের পর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের অনেক চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র হয়েছে। জনসমর্থন না থাকলে ষড়যন্ত্র করে হত্যাকাণ্ড ঘটানো যায়, কিন্তু ক্ষমতায় আসা কিংবা টিকে থাকা যায় না। আওয়ামী লীগকে নিয়ে যত বেশি নাড়াচাড়া কিংবা ষড়যন্ত্র করা হবে, আওয়ামী লীগের জনসমর্থনের শেকড় আরও বেশি শক্তিশালী হবে- এটা সবাইকে মনে রাখতে হবে। জনগণের সমর্থন নিয়েই প্রতিবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জনগণের মঙ্গলে ও কল্যাণে কাজ করেছে, যার শুভ ফলও জনগণ পাচ্ছে। এত অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যাকাণ্ডের পরও আওয়ামী লীগ টিকে আছে শুধু জনগণের সমর্থনেই।’
সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে সব সন্ত্রাসী, খুনিচক্র ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্র তারা বসে নেই। ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের ঘটনা ঘটিয়েও তারা ক্ষমতাকে ভোগ করতে পারেনি জনগণের কারণে, এটাই তাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ।’
তিনি বলেন, ‘অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে গঠিত রাজনৈতিক দল (বিএনপি, জাতীয় পার্টি) কখনওই দেশ ও জাতির কল্যাণ করতে পারে না। ক্ষমতাকে তারা নিজেদের ভাগ্য গড়ার কাজে ব্যবহার করে, জনগণ কিছু পায় না। আওয়ামী লীগই দেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল যেটি দেশের মাটি ও মানুষের মধ্যে থেকে দেশের মাটিতে জন্ম নিয়েছে। আমরা ক্ষমতায় এলেই দেশ উন্নতি হয়, দেশের মানুষের কল্যাণ হয়, বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে চলতে পারে- আমরা তা প্রমাণ করেছি।’
নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের সমালোচনার জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অনেকে হয়তো ভুলে যান, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনে শুধু ভোট চুরির অপরাধেই খালেদা জিয়াকে দেশের জনগণ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মাত্র দেড় মাসের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে দেশকে দুর্নীতিতে পাঁচবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেছিল, বাংলাভাই ও জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করেছিল। ’৯১ সালেও জামায়াতের হাত ধরে ক্ষমতায় এসেছিল খালেদা জিয়া। ভোট চুরির কারণেই দেশের জনগণ ’৯৬ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়াকে ভোট দেননি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশের মানুষের জন্য কাজ করে, দেশের উন্নতি হয়, দেশ এগিয়ে যায়, মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়- এটা আমরা প্রমাণ করেছি বলেই জনগণ বারবার নির্বাচনে আমাদের সমর্থন দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘দেশের একটি শ্রেণি আছে তাদের কাজই হচ্ছে সরকারের সমালোচনা করা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অবৈধভাবে জিয়া, এরশাদ এবং এরপর খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসেছে। এদের মূল লক্ষ্যই ছিল- দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, খুন ও সমাজে সংঘাত সৃষ্টি করা। এর মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করেছে।’
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘জিয়া-এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলে নির্বাচন কেমন ছিল? ১০টা হোন্ডা, ২০টা গুন্ডা- নির্বাচন ঠান্ডা। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ভোটে হারেনি, ষড়যন্ত্র করে হারানো হয়েছিল। খালেদা জিয়া এক কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার দিয়ে তালিকা করেছিল।’
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সন্ত্রাস, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদের কারণেই দেশে ওয়ান/ইলেভেনের সৃষ্টি হয়েছিল উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারও খালেদা জিয়ার হাতেই তৈরি। প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দিন আহমদকে খালেদা জিয়াই নিয়ে এসে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বানিয়েছিলেন। ৯ সিনিয়র জেনারেলকে ডিঙ্গিয়ে মঈন ইউ আহমদকে সেনাপ্রধানও করেছিলেন এই খালেদা জিয়া। এরা সবাই তার পছন্দের লোক ছিলেন। কিন্তু ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নতুন দল গঠনের চেষ্টা করল। যাকে আমি গ্রামীণ মোবাইল ফোনের লাইসেন্স দিয়েছিলাম, সেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস আর ডেইলি স্টারের সম্পাদককে (মাহফুজ আনাম) নিয়ে নতুন দল গঠনের চেষ্টা করা হলেও জনগণ তাতে সমর্থন দেয়নি।’
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আরেকজন যিনি মারা গেছেন (ফেরদৌস আহমেদ কোরাইশি), তাকে নিয়ে কিছু বলতে চাই না, তাকে দিয়েও কিংস পার্টি গঠনের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেখানেও জনগণ কোন সাড়া দেয়নি। ওই সরকার কিন্তু প্রথমেই আমাকে গ্রেফতার করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থক, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষসহ আন্তর্জাতিক চাপে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ওই সময়ের একটি শ্রেণির ধারণা ছিল, কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না, কিন্তু দেশের জনগণ বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে। এরপর একটার পর একটা নির্বাচনে জনগণের ভোট নিয়েই আমরা তাদের সেবা করে যাচ্ছি। যারা জনগণের কাছে ভোট চাইতে পারে না, যাদের তৃণমূলে সংগঠন নেই- তাদের কেন জনগণ ভোট দেবে?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে আজকে আমরা এখানে সমবেত হয়েছি। দুঃখের বিষয় হলো- করোনাভাইরাসের কারণে আমরা এই সভা খুব লম্বা করতে পারছি না। আমরা আশা করি, একদিন এই করোনাভাইরাস চলে যাবে। আবার আমরা একসঙ্গে মিলিত হবো। সব অনুষ্ঠানই আমরা স্বাভাবিক নিয়মে করতে পারব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল নিল খুনি মোশতাক। মোশতাক যে চক্রান্ত করেছিল, তার সঙ্গে যারা ছিল সেটা প্রমাণিত হয়ে গেল। সে রাষ্ট্রপতি হয়েই সঙ্গে সঙ্গে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান করল। তাই খুব স্বাভাবিকভাবে এটা প্রতীয়মান হয় যে ষড়যন্ত্রের সঙ্গে মোশতাকের একেবারে ডান হাতই ছিল জিয়াউর রহমান। তারা শুধু ষড়যন্ত্রের সঙ্গেই ছিল না, খুনিদের দায়মুক্তি দেয়া এবং দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিন্নপথে নিয়ে যাওয়া শুরু করল।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘২ নভেম্বর রাতে কেন্দ্রীয় কারাগারে খুনিদের প্রবেশ। কারাগার সবসময়ই সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গেই লকআপ হয়। এরপর কেউ আর প্রবেশ করতে পারে না। সেদিন গভীর রাতে ১৫ আগস্টের খুনিরা যখন কারাগারে প্রবেশ করার জন্য হাজির হলো তখন কারাগারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা তাদের বাধা দিয়েছিল। সেই সময় অজ্ঞাত স্থান থেকে টেলিফোন যায়। বলা হয়, ‘না তাদের প্রবেশ করতে দেয়া হোক। কারণ তারা নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে যাচ্ছে।’ কিন্তু সেই সঙ্গে তারা আবার অস্ত্র নিয়ে যাবে। সেখানেও তারা বাধা দিয়েছিল। কিন্তু সেই বাধাটাও তাদের বিরত করা হলো। বলা হলো- তারা যেভাবে যেতে চায়, সেভাবে যেতে দেয়া হোক। অন্য সকলকে সরিয়ে দিয়ে এই চার নেতাকে একটা সেলে নিয়ে আসা হয়। সেখানেই তাদের নির্মমভাবে গুলি করা হয়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৫ আগস্টের ঘটনাকে যারা একদিন একটা পারিবারিক ঘটনা বলে অপপ্রচার চালাতে চেষ্টা করেছিল। তাদের আসল উদ্দেশ্যটা ধরা পড়ে যায় ৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যারা মানতে পারেনি। স্বাধীন বাংলাদেশটা যারা স্বীকার করেনি, স্বাধীন বাংলাদেশটা যারা চায়নি তাদের দোসরাই ছিল এই হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা।’
তিনি বলেন, ‘এরপর মোশতাকও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। কারণ যারা বেঈমানি করে, মীরজাফর হয়। মীরজাফর একটা গালি হয়ে গিয়েছিল, কারণ সে সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বেঈমানি করেছিল। মোশতাক আরেকজন, যে বেঈমানি করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, ৩ নভেম্বর কারাগারে হত্যা করে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মোশতাকের পতনের পরে জিয়াউর রহমান সংবিধান লঙ্ঘন করে একদিকে সেনাপ্রধান, অপরদিকে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেয়। যেটা সেনা আইনেও নেই। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দেন। বন্ধ করে দিয়ে সাজাপ্রাপ্ত ও বন্দিদের মুক্ত করে দেন। সাত খুনের আসামিকেও মুক্ত করে এনে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। এভাবে খুনিদের মুক্ত করে দিয়ে রাজনীতি ও নেতা বানানোর প্রচেষ্টা করেছিলেন। অন্যদিকে সত্যিকারের রাজনৈতিক ও ত্যাগী নেতাদের ওপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালিয়েছিলেন। জিয়া সেই সময় বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেছিলেন উল্লেখ করে অনেকই তার সঙ্গে চলে গিয়েছিল। তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিল। কিন্তু একবারও তারা কি ভেবে দেখেছে, যারা অবৈধভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতায় আসে তারা গণতন্ত্র দিতে পারে না। সেই গণতন্ত্র, গণতন্ত্র হয় না। কতগুলো দল করতে দিয়েই সেটা গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা হয় না। যদি হতো এই দেশ অনেক উন্নতি করতে পারত। মানুষের কাছে জবাবদিহি থাকতে পারত। মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারত।’