সন্ত্রাসীদের তান্ডবে লন্ডভন্ড দেশমাতৃকা !

0

বৃহস্পতিবার,
৯ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২৫ জুলাই ২০২৪ ইং ,
বিশেষ প্রতিনিধিঃ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলা আন্দোলনের নামে একদল দুষ্কৃতকারী সরকারি স্থাপনায় তা-ব চালিয়েছে। যাত্রাবাড়ীতে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজায় আগুন তা-বে একে একে পুড়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বনানী ও মহাখালী টোলপ্লাজা, বিটিভি ভবন, সেতু ভবন, মেট্রোরেলের স্টেশন। মিরপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে হামলা চালানো হয়েছে। তা-বের শিকার হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়, মিরপুরের ইনডোর স্টেডিয়াম। বিআরটিএ ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি ও ট্রাফিক বক্স। হামলা চালানো হয়েছে থানায়ও। স্বাধীন বাংলাদেশে এর আগে কখনো এভাবে তা-ব চালানো হয়নি।

শুধু রাজধানীতে নয়, দুষ্কৃতকারীরা তা-ব চালিয়েছে ঢাকার বাইরেও। নরসিংদীতে জেলা কারাগার এবং পৌরসভা ও ইউনিয়ন কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে। নরসিংদীতে কারাগার ভেঙে ৯ জন জঙ্গিসহ ৮২৬ বন্দি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে চালানো হয়েছে তা-ব।

দৃষ্কৃতকারীদের তা-বে রাজধানীসহ সারাদেশে জনমনে সৃষ্টি হয় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। পরিস্থিতি সামাল দিতে একপর্যায়ে কারফিউ জারি করে সরকার। সেই সঙ্গে নামানো হয় সেনাবাহিনী। এতে অনেকটাই ঘরবন্দি হয়ে পড়েন মানুষ। প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে খুব একটা বের হননি। তবে সেনাবাহিনী রাস্তায় নামার পর অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।

রোববার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলেও বুধবার থেকে সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়া হয়েছে সরকারি-বেসরকারি অফিস। সীমিত পরিসরে চলছে ব্যাংকিং কার্যক্রম। ব্যাংক খোলায় শেয়ারবাজারেও লেনদেন চালু করা হয়েছে। রাস্তায় চলাচল করছে গণপরিবহন। ফলে মানুষের মনে স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে।

হামলাকারীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে দল বেঁধে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয়। সেই সঙ্গে তা-ব চালানো হয় একের পর এক সরকারি স্থাপনায়। আগুন দেওয়া হয় বিআরটিএর ডেটা সেন্টারে বন্ধ হয়ে যায় ইন্টারনেট সেবা। গ্যাস-বিদ্যুৎ নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েন রাজধানীর বাসিন্দারা। নানা শঙ্কা দানা বাঁধে জনমনে।

এর আগে সোমবার নিজ কার্যালয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় হামলার কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

বৈঠকে ব্যবসায়ীরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে থাকার অঙ্গীকার করেন। সেইসঙ্গে বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা করা দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।

তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, আক্রমণগুলো পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। জঙ্গিরা যেভাবে আক্রমণ করে সেভাবে। তিনি বলেন, ডেটা সেন্টার জালিয়ে দেওয়া হচ্ছে যেন ইন্টারনেট বন্ধ থাকে, দেশ অচল হয়ে যায়। কেপিআই ভবনে কারা আক্রমণ করে? ডেটা সেন্টার পুড়িয়ে দিয়েছে, বিটিভি জ্বালায়ে দিয়েছে, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বিটিসিএল ল্যান্ডলাইন জ্বালিয়ে দিয়েছে, সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, মেট্রোরেলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ জ্বালিয়ে দিয়েছে। উন্নয়ন যেখানে হয়েছে সেখানেই হামলা হয়েছে।

হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজায় আগুন দেওয়ার পর বৃহস্পতিবার বিআরটিএর প্রধান কার্যালয় হামলা চালানো হয়। এরপর শুক্রবার আবার বিআরটিএ’র প্রধান কার্যালয়ে হামলা চালানো হয়। হামলা চলানো হয় বিআরটিএ’র মিরপুর কার্যালয়ে। বিআরটিএ ভবনের বিভিন্ন তলায় ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় দুষ্কৃতকারীরা। লুট করা হয় মূল্যবান জিনিসপত্র।

দুষ্কৃতকারীরা মহাখালীতে সেতু ভবনের সামনে থাকা যানবাহনে আগুন দেয়। সেইসঙ্গে আগুন দেওয়া হয় ভবনের নিচতলায়। তাদের দেওয়া আগুনে সেতু বিভাগের ৫৫টি গাড়ি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। সেতু ভবনের নিচতলায় থাকা বঙ্গবন্ধু কর্নার, অভ্যর্থনা কেন্দ্রে, মিলনায়তন, ডে-কেয়ার সেন্টারও পুড়েছে। আগুনে পুড়েছে সেতু ভবনের উপরের ফ্লোরও। লুট করা হয়েছে ভবনের মূল্যবান জিনিসপত্র। এ ঘটনায় সেতু ভবনের ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণসহ সার্বিক বিষয় তদন্তে অতিরিক্ত সচিব রাশিদুল হাসানকে প্রধান করে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

দুষ্কৃতকারীদের হামলার শিকার হয়েছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বনানী ও মহাখালীর টোলপ্লাজা। ফলে আপাতত এ দুটি টোলপ্লাজা বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক এএইচএস আকতার।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কয়েকটি আঞ্চলিক কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ৩০টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে, ভাঙচুর করা হয়েছে ১৭টি গাড়ি। মশার ওষুধ ছিটানোর স্প্রে মেশিন, মশার ওষুধ নষ্ট করা হয়েছে, তুলে নেওয়া হয়েছে সড়কবাতি। হামলায় ডিএনসিসির প্রায় ২০৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।

হামলাকারীরা মহাখালীর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনের সামনে এবং বেইজমেন্টে থাকা যানবাহনে আগুন দেয়। আগুন দেয়া হয় ভবনেও। এ হামলায় ৫৩টি গাড়ি ও ১৬টি মোটরসাইকেল সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। ভবনের বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন, সার্ভার, ইমার্জেন্সি রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার, অফিসের যন্ত্রপাতিও নষ্ট হয়েছে।

মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে বড় ধরনের নাশকতা চালিয়েছে হামলাকারীরা। টিকিট বিক্রির মেশিন, কম্পিউটার, প্রিন্টার, সময়সূচির মনিটর, ভেঙে ফেলা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অ্যাকসেস কন্ট্রোল গেট। এ ঘটনায় আট সদস্যের কমিটি করে দিয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড।

দুটি স্টেশন পুনরায় সচল করতে আরও অন্তত এক বছর সময় লাগবে জানিয়ে শনিবার ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক সাংবাদিকদের বলেন, যেসব যন্ত্রপাতি ভাঙচুর করা হয়েছে সেগুলো বাংলাদেশে নেই। এগুলো জাপান ও ইউরোপ থেকে আনতে হবে। এজন্য দরপত্র আহ্বান করত হবে। কেনার প্রক্রিয়া শেষ হলে এগুলো স্টেশনে সংযোজন করতে হবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ জানায়, সহিংসতায় ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন দিয়ে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকার ক্ষতি করা হয়েছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গুলশানে ট্রাফিক উপ-কমিশনারের অফিস। এসি রমনা, রামপুরা, মহাখালী ও উত্তরা অফিস পুড়িয়ে হয়েছে। পুরো ঢাকা শহরে মোট ৫৪টি ট্রাফিক পুলিশ বক্স পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

ধানমন্ডিতে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ-বিসিএসআইআরে হামলা করে দুষ্কৃতকারীরা আটটি গাড়ি ভাঙচুর করে। আগুন দেওয়া হয় নরসিংদী জেলা কারাগারে। কারাগার ভেঙে ৯ জঙ্গিসহ মোট ৮২৬ কয়েদি পালিয়ে যায়। এ সময় কারাগার থেকে ৮৫টি অস্ত্র ও আট হাজারের বেশি গুলি ছিনিয়ে নেয় হামলাকারীরা।

এ বিষয়ে নরসিংদী জেলা কারাগারের জেল সুপার আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, আক্রমণের সময় কয়েক হাজার হামলাকারী এসে প্রথমে কারাগারের মূল ফটক ভেঙে ফেলে এবং ভেতরের ফটক আক্রমণ করলে কারারক্ষীরা প্রথমে তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাণ বাঁচাতে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন।

দুষ্কৃতকারীরা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়কের সাইনবোর্ড এলাকায় আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস আগুন দেয়। এতে চারতলা ভবনটি একেবারে পুড়ে যায়। গ্রাহকদের দেওয়ার জন্য তৈরি করা আট হাজার পাসপোর্ট পুড়ে গেছে।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *