যুদ্ধের মাঠেও এগিয়ে বাংলার নারী শান্তিরক্ষীরা
১৪ আষাঢ় ১৪২০ বঙ্গাব্দ,
২৮ জুন ২০২৩ ইং,
অন লাইন ডেক্সঃ
এগিয়ে যাচ্ছে নারী। ঘরে-বাইরে, রাজনীতির মঞ্চে কিংবা অফিস-আদালতে নারীর ক্ষমতায়ন এবং এগিয়ে যাওয়ার চিত্র এখন সবার কাছেই দৃশ্যমান। কিন্তু নারী এখানেই সীমাবদ্ধ নন, যুদ্ধের মাঠেও তথা সম্মুখ সমরেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। বলছি- বাংলাদেশের নারী শান্তিরক্ষীদের কথা। যারা হাজার হাজার মাইল দূরে ভিন্ন দেশেও দুর্গম-ভয়ানক পরিবেশ পরিস্থিতিতে পুরুষ শান্তিরক্ষীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অভিযানে অংশ নিচ্ছেন। এই নারী শান্তিরক্ষীরা সশস্ত্র অপারেশনের বাইরেও তারা মমতাময়ী বা বাঙালি নারীর স্বভাবের বহিঃপ্রকাশ ফুটে তুলেছেন গোলযোগপূর্ণ বিভিন্ন দেশে। যার অন্যতম একটি পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে।
মালির রাজধানী বামাকো, গাঁও প্রদেশসহ একাধিক অঞ্চলে বাংলাদেশের নারী শান্তিরক্ষীদের নিয়ে সাধারণ মানুষের ব্যাপক প্রশংসা শোনা যায়। বিশেষ করে বিভিন্ন অভিযানে গিয়েও স্থানীয় নারী-শিশুদের প্রতি বাংলাদেশ নারী শান্তিরক্ষীদের নানা ধরনের স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষামূলক কর্মকান্ড- তাদেরকে অনন্য করে তুলেছে। যাদের মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুজন নারী শান্তিরক্ষী চিকিৎসক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাহমিনা এবং ক্যাপ্টেন হুমায়রার নাম স্থানীয় জনগণের মুখে মুখে।
এ প্রসঙ্গে মালিতে নিযুক্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যানব্যাট-৯ কন্টিনজেন্টের কমান্ডার (সিসি) কর্নেল মো. আমিনুল হক বলেন, মালিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা উচ্চ পেশাদারত্ব, দায়িত্বশীলতা এবং মানবিকতার গুণে স্থানীয়দের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। যার মূল অংশে রয়েছে আমাদের নারী শান্তিরক্ষীদের সামাজিক ও মানবিক নানা কর্মকান্ড-। আমাদের নারী শান্তিরক্ষী চিকিৎসক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাহমিনা এবং ক্যাপ্টেন হুমায়রা এখানে কাজ করতে গিয়ে এমনভাবে জনপ্রিয় হয়েছেন যে, মালির যেকোনো গ্রামে গিয়ে তাদের নাম বললেই সবাই চেনে। তারা অথবা আমাদের নারী শান্তিরক্ষীরা মালির প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে গেলে সেখানকার সাধারণ নারী ও শিশুরা ছুটে আসেন। আমাদের নারী শান্তিরক্ষীরাও তাদের নিয়মিত ফলোআপ, চিকিৎসাসেবা ও বিনামূল্যে ওষুধ, শুকনো খাবার এবং পানি সরবরাহ করে থাকেন। এর ফলে স্থানীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক আতিথেয়তার পর্যায়ে চলে গেছে।
কর্নেল আমিনুল হক বলেন, মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে মালির নারীরা খুবই পর্দানশীল এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। আমরাও তাদের সেখানে সর্বোচ্চ সম্মান দেখানোর চেষ্টা করি। স্থানীয় নারীদের যেকোনো ধরনের সহযোগিতার ক্ষেত্রে আমরা নারী শান্তিরক্ষীদের পাঠাই। নারীদের জন্য অবশ্যই নারী চিকিৎসক দিয়ে সেবা দেওয়া হয়। আমাদের নারী শান্তিরক্ষীরা যখন কোনো গ্রামে যাচ্ছেন বা স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলছেন তখন তারাও হিজাব পড়ে সম্মানের সঙ্গে কথা বলছেন। নিজেদের খাবার ও ওষুধ স্থানীয় অসহায়দের দিয়ে দিচ্ছেন। ফলে এসব কর্মকা- কেবল মালির স্থানীয় জনগণ তথা জাতিসংঘও অত্যন্ত প্রশংসা করছে। তিনি জানান, এ পর্যন্ত ছয়-সাত হাজার মালিয়ান নাগরিকের কাছে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) রয়েছে। এই প্রেসক্রিপশনে এক পাশে বাংলাদেশের পতাকা অন্যদিকে মালির পতাকার ছবি রয়েছে। মূলত এই প্রেসক্রিপশন দিয়ে তারা আমাদের নারী শান্তিরক্ষী চিকিৎসকদের কাছে ফলোআপ চিকিৎসাসেবা নেন।
এ প্রসঙ্গে মালির জনপ্রিয় সেই শান্তিরক্ষী চিকিৎসক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাহমিনা বলেন, আমরা এখানে গাঁও সুপার ক্যাম্পে এবং অপারেশনে গিয়ে বিভিন্ন গ্রামে স্থানীয় নারী-শিশুসহ সাধারণ নিরীহ মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকি। তারাও জানেন যে, ব্যানব্যাট কন্টিনজেন্ট কোনো অভিযানে গেলে সেখানে নারী চিকিৎসক শান্তিরক্ষীরাও সঙ্গে থাকেন। ফলে যখনই আমরা কোনো এলাকায় অপারেশনে যাই তখন স্থানীয়রা আমাদের দেখলেই চিকিৎসাসেবা নিতে ছুটে আসেন। যারা অসুস্থতা বোধ করেন তাদেরকে আমরা বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধপত্র দিয়ে থাকি। অনেকে অনেক দিন ধরে আমাদের কাছ থেকে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। তিনি জানান, আমরা তাদের এমনভাবে প্রেসক্রিপশন করে দেই যেখানে ইংরেজির পাশাপাশি স্থানীয় ভাষায় ওষুধ এবং রোগের ‘হিস্ট্রি’ উল্লেখ থাকে।
তিনি বলেন, এখানে কাজ করতে গিয়ে আমরা প্রচুর ‘ক্রনিক প্যাশেন্ট’ পাচ্ছি। ডায়বেটিসের হার মারাত্মক হারে দেখা যায়। অথচ, তারা জানেও না যে তাদের শরীরের ওই অবস্থা। মাঠ পর্যায়ে অপারেশনে গিয়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি গাঁও শহরে ব্যানব্যাট-৯ কন্টিনজেন্টের সুপার ক্যাম্পে ‘লেভেল-১ হাসপাতাল’ পরিচালনা করি। যেখানে সব শান্তিরক্ষীদের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনও গুরুতর অসুস্থ হলে চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন। ফলে বাংলাদেশ নারী শান্তিরক্ষীদের সম্মান ও অবস্থান এখানে গর্ব করার মতো।
ব্যানব্যাট-৯-এর ফিমেল এঙ্গেজমেন্ট টিমের কমান্ডার ক্যাপ্টেন নিশান বলেন, আমরা নিজ দেশ থেকে বহুদূরে এসে অনেক কষ্ট করে প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে শান্তিরক্ষা মিশনের সব কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে থাকি। এখানে নারী আর পুরুষ বলে দায়িত্বে আলাদা কিছু নেই। একাধিক ক্ষেত্রে দেখেছি, আমার সৈনিক কোনো এলাকায় অপারেশনে গেছেন, আর সেখানে গিয়ে শুনেছেন তার বাবা বা শাশুড়ির মৃত্যুর খবর। তখন পরিবেশটা তার কাছে কেমন হবে তা সহজেই চিন্তা করা যায়। কিন্তু নারী শান্তিরক্ষীরা সেই করুণ পরিস্থিতিতেও অপারেশন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেননি। মনোবল ঠিক রেখে অভিযান শেষ করেই ক্যাম্পে ফিরেছেন। আর এই দৃঢ় মনোবলের নেপথ্যে রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং দেশের সম্মানের বিষয়। তিনি বলেন, আমরা এখানে একটি টিমের মতো করে দায়িত্ব পালন করে থাকি। নারী শান্তিরক্ষী সদস্যদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখি। আমাদের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেই।
মরুর বুকে শান্তিরক্ষা মিশনের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে শান্তিরক্ষী ল্যান্স কর্পোরাল ফাতেমা বলেন, আমি এখানে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর শান্তিরক্ষী মিশনে এসেছি। স্বামী, সন্তান ও মা-বাবাকে ছেড়ে এত দূরে থাকতে কষ্ট হয়। ছোট বাচ্চা দেশে রেখে এখানে দায়িত্ব পালন করাটা একজন মা হিসেবে অনেক কষ্টের। কিন্তু দেশের প্রতি এবং বাহিনীর প্রতি নিজের দায়িত্ববোধ থেকে সব কষ্ট হাসিমুখে সহ্য করি। এই দুর্গম এলাকায় কঠিন পরিস্থিতিকেও মানিয়ে নিয়ে দেশের সম্মানের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছি। কেননা আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সদস্য।