মিছিলে ইপিআর গুলি ছুড়েছিল

0

আগুনঝরা মার্চ
বদর উদ্দিন আহমদ কামরান

Bp-2017-03-14-097-5

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ডাকা হয় জাতীয় অধিবেশন। কিন্তু সেই অধিবেশন ১ মার্চ যখন স্থগিত করা হয় তখন আমরা বুঝে যাই পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহনা শুরু করেছে। পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে সারা দেশের মতো সিলেটের মানুষও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ক্ষোভ রাজপথের আন্দোলনে রূপ নেয়। এক সময় সিলেটের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, ছাত্র-জনতা পাকিস্তানবিরোধী স্লোগান নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। সবার মুখে মুখে ছিল একই স্লোগান—‘তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা। তুমি কে, আমি কে—বাঙালি, বাঙালি। ’ ১ মার্চের পর থেকে প্রতিদিন সকাল ১০টার দিকে নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন মিছিল নিয়ে সুরমা মার্কেট পয়েন্ট ও কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় জড়ো হতো। বিকালে সমাবেশ হতো। ১৯৭১ সালে আমি সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। আমার বয়স তখন ১৭। সুযোগ পেলেই আমি মিছিলে ছুটে যেতাম। বড়দের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে স্লোগান ধরতাম। ৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন। দুপুর থেকে মানুষ রেডিওর সামনে জড়ো হতে থাকেন। কিন্তু বেতার থেকে ঐতিহাসিক সেই ভাষণ সম্প্রচার না করায় মানুষের ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। যাদের বাসায় টিএন্ডটি ফোন ছিল ঢাকায় যোগাযোগ করে তারা জানতে পারেন বঙ্গবন্ধু তার ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন। জনতার ক্ষোভের মুখে পরদিন সকালে বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ শুনতে পান সিলেটের মানুষ। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ কেবল বক্তৃতা নয়, এর মধ্যে ছিল যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ ও স্বাধীনতার দিক-নির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর সিলেটের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা ও একই সঙ্গে প্রতিরোধের মনোভাব গড়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু জানতেন রক্ত ছাড়া স্বাধীনতা আসবে না। তাই তার বক্তৃতায় বলেছিলেন—‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব-ইনশাআল্লাহ। ’ তিনি জানতেন এই যুদ্ধে প্রাণহানি ঘটবে। এমন প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য তার বক্তৃতায় স্পষ্ট উচ্চারণ ছিল, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। ’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই বক্তব্য আত্মস্থ করতে পেরেছিল সিলেটের মানুষ। তাই এই বক্তব্যের পরই সিলেটে মূলত মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। প্রতিদিন শহরে বিশাল বিশাল মিছিল হয়। প্রায়ই সেই মিছিলে যেতাম। সারা দিন মিছিল করে বাসায় ফিরতাম। নগরীর নয়াসড়কে বর্তমানে যেখানে খাজাঞ্চিবাড়ি স্কুল ১৯৭১ সালে সেখানে ছিল ইপিআর ক্যাম্প। মার্চের শেষের দিকে (সম্ভবত ২০-২৩ মার্চের মধ্যে হবে) ইপিআর ক্যাম্পের উদ্দেশে বের করা হয় মিছিল। দেওয়ান ফরিদ গাজীর নেতৃত্বে সেই মিছিলে অংশ নেই আমি। হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে মিছিলটি যখন জেল রোড পয়েন্টে যায় তখন ইপিআর ক্যাম্প থেকে গুলি ছোড়া হয়। গুলি ছুড়ে ইপিআর সদস্যরা মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তখন আমাদের মিছিলের স্লোগান ছিল—‘বাঁশের লাঠি তৈরি কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। সংহতিতে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। ২৪ মার্চ মিছিল করে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে বাসায় ফিরি। বাসায় এসে জানতে পারি আমার চাচা গোলাম রব্বানী অসুস্থ হয়ে সিলেট সদর হাসপাতালে ভর্তি। ২৬ মার্চ তিনি হাসপাতালে মারা যান। তখন রাস্তায় বের হওয়া যাচ্ছিল না। রাস্তায় পাক আর্মি ঘুরাফেরা করছিল। এ অবস্থায়ই লাশ আনতে রওয়ানা দিই হাসপাতালে। পথে জিন্দাবাজারের যেস্থানে বর্তমানে সোনালী ব্যাংক সেখানে রাস্তায় কয়েকজন বাঙালি পুলিশের লাশ পড়ে থাকতে দেখি। ফেরার সময় মির্জা জাঙ্গাল নিম্বার্ক আশ্রমের সামনে আরেক ব্যক্তির লাশ পড়ে থাকতে দেখি। লাশের পায়ের অংশ ক্ষত-বিক্ষত। মনে হচ্ছিল রাতে শেয়াল বা কুকুর হয়তো লাশের অংশ বিশেষ খেয়ে ফেলেছে। দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে তাড়াহুড়ো করে আমরা চাচার লাশ দাফন করি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সিলেটের বাণিজ্যিক এলাকা কালিঘাটে প্রায়ই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গাড়ি আসত। আমরা প্রতিরোধ করার জন্য পার্শ্ববর্তী স’মিল থেকে গাছের গুঁড়ি ও দোকান থেকে তেলের ড্রাম রাস্তায় ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টির চেষ্টা করতাম।

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই আমার মনে পাকিস্তানি সম্পর্কে ঘৃণার সঞ্চার হয়। স্কুলছাত্র হলেও তখন পাকিস্তানিদের নানা শোষণ ও অবজ্ঞা আমাকে আহত করে। তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সিলেট সদর আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেওয়ান ফরিদ গাজীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেই আমি। সিলেট শহরে যেখানেই ফরিদ গাজীর জনসভা হতো সেখানে সভার মূল কাজ শুরুর আগে আমি অনুপ্রেরণামূলক পাকিস্তানবিরোধী গান গাইতাম। এখনো সেই গানগুলোর কয়েকটি মনে আছে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল—‘আমরা ভুলব না, ভুলব না/ যুদ্ধকালীন বিপদ ভুলব না। বাঙালিদের আগে দিয়া, পাকিস্তানিরা থাকে পিছে/ বাঙালিরা না থাকলে পাঞ্জাবিরা যাইতো ৭ হাত মাটির নিচে। ’ এ ছাড়া আরেকটি গানের লাইন ছিল—‘বাঙালিদের চাকরি দিতে সরকারের নাই মনে/ বাঙালি মানুষকে সরকার পশুর মতো গুনে। ’ বঙ্গবন্ধুর গৌরবোজ্জ্বল নেতৃত্বের কথা তুলে ধরে গান গাইতাম—‘শেখ মুজিবকে জেলে নিয়ে দিতে ছিল যাতা। খোদায় বানাইছে তারে আন্তর্জাতিক নেতা। দয়াল রব্বানা…। ’

লেখক : সভাপতি- সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ ও সাবেক মেয়র।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *