পদ্মা সেতুর ১ বছর: শিল্প-বাণিজ্যে অভাবনীয় পরিবর্তন মাদারীপুরে

0

১১ আষাঢ় ১৪২০ বঙ্গাব্দ,
২৫ জুন ২০২৩ ইং,
জেলা প্রতিনিধিঃ

এক বছরের ব্যবধানে দেশের শিল্প-বাণিজ্যে অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে মাদারীপুরে। ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর বদলে গেছে মাদারীপুরের অর্থনীতির চিত্র। রাজধানী থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরত্বে হওয়ায় মাদারীপুরে বিভিন্ন কৃষি বাজারে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, কুষ্টিয়া, ফেনী, গোপালগঞ্জ, নাটোর, যশোর, রাজশাহী, ময়মনসিংহসহ প্রায় সারাদেশের ব্যবসায়ীরা কৃষি পণ্য ক্রয় করতে আসেন। মাদারীপুরে ধান, পাট, গম, মরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, সরিষা, কালোজিরা, তিলসহ আলু, কুমড়া, করলা, বেগুন, কচু, চিচিংগা, ঝিংগা, ডাটা, লালশাক, পুঁইশাক, পেঁপে, শসা, লাউ, টমেটো, পটল, আখ, ডাল, ধনিয়াসহ সব ধরণের কৃষি পণ্য উৎপাদন করে এ অঞ্চলের কৃষকেরা।

শিবচরের দত্তপাড়া ইউনিয়নের সূর্যনগর বাসিন্দা রুবেল বলেন, মাদারীপুর জেলা ছাড়াও অন্য জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা জমি কিনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় এখানে জমির দাম পাঁচগুণ থেকে সাতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেভাবে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে তাতে দাম আরও বৃদ্ধি পাবে। এক সময় এই জেলা বাণিজ্যিক জেলায় রুপান্তর হবে।

আনোয়ার অটো রাইচ মিলে মালিক আনোয়ার হোসেন মুফতি বলেন, আমি অনেক বছর ধরে মিল কারখানা ও গবাদি পশুর খামার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আমি প্রথমে ভয়ে ভয়ে ব্যবসা শুরু করেছি। আজ পদ্মা সেতুর কারণে আমি ব্যবসায় বড় করতে পারব। তাই রাইচ মিল কারখানা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি। এই মিলে ৫০ জনের বেশি কর্মসংস্হানের সুযোগ-সুবিধা হয়েছে। এখন থেকে আমার ব্যবসার একটা বড় অংশ মাদারীপুর শহরে গড়ে তোলার জন্য বিনিয়োগ করব। এতে জেলার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। স্থানীয় ক্ষদ্র ব্যবসায়ীরাও অল্প পুঁজিতে ভালো ব্যবসা করতে পারবেন। রাইস মিল মালিক হালিম শিকদার বলেন, পদ্মা সেতুতে আমাদের উন্নয়ন হয়েছে। এখন আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হয়েছে। যেখানে ঢাকা যেতে ৫ ঘণ্টা লাগত সেখানে এখন আমরা দেড় থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছাতে পারি। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে আমরা চাল বিক্রি করতে পারি। মোল্লা ফিলিং স্টেশনের মালিক জানান, এদিকে পদ্মা সেতু হওয়ায় একাধিক ফিলিং স্টেশন হয়েছে। মানুষের নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। বিসমিল্লাহ এগ্রো ফুডের মালিক বিপ্লব বলেন, আগে পণ্য দ্রব্য নিয়ে রাজধানীতে যাতায়াতে অনেক সময় লেগে যেত। এখন আমাদের অনেক সুবিধা হয়েছে। আমাদের ব্যবসা সম্প্রচার করতে সুবিধা হবে।

নারী উদ্যোক্তা রিনা বলেন, আগে কাজ কম পেতাম, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর অনেক কাজ পাই। এখন আর পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয় না। বাড়ি থেকে আসা যাওয়া করেই কাজ করতে পারছি। বেতন যা পাই, তা দিয়ে সংসার খরচ চলে যায়।

মাদারীপুরের সবজি ব্যবসায়ী আবুল হোসেন বলেন, তার এলাকায় উৎপাদিত সবজি ট্রাকভর্তি করে ঢাকায় পাঠাতে ফেরিতে ৪-৫ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো। অনেক সজবি নষ্ট হতো। ট্রাক ভাড়াও বেশি গুণতে হতো। এখন পদ্মা সেতু দিয়ে পণ্য পাঠানোর কারণে খরচ কমে গেছে, সবজিও তাজা থাকছে। যেকোনো সময় কাঁচামাল ভর্তি ট্রাক রাজধানীতে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। এর ফলে আমার মতো অন্য ব্যবসায়ীরাও লাভবান হয়েছে।

গরুর খামারিরা জানান, এ জেলা থেকে ব্যবসায়ীদের মধ্যে কোরবানির গরু নিয়ে রাজধানীর হাটে যেতে আগের মতো কোনো দুশ্চিন্তা বা উৎকণ্ঠা দেখা যায়নি। কারণ দিন-রাত যেকোনো সময়েই পদ্মা পার হওয়া যায়।

সবজির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন বাড়াতে পতিত জমিকে চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসতে কাজ শুরু করছে স্থানীয় প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ। মানসম্মত ফসল উৎপাদনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ১৫ হাজার কৃষক ও কৃষাণিকে। মাটির ধরণ অনুযায়ী অনাবাদী জমিতে সবজি উৎপাদনে কাজ শুরু করেছে কৃষি বিভাগ। এছাড়া নতুন করে চাষাবাদের আওতায় আনা হয়েছে ৪ হাজার ৭২০ হেক্টর অনাবাদী জমি। যার ফলে গত রবি মৌসুমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৬৭ কোটি টাকার।
শিবচরে চাষি আনোয়ার বেপারি বলেন, আমি লাউ ও কচু চাষ করেছি। রাজধানীর কাওরান বাজার বিভিন্ন পাইকাররা এসেছে আমার চাষ করা সবজি কিনতে। আমি তাদের কাছে আমার উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পেরেছি। কৃষি পণ্য উৎপাদন, বিক্রিসহ জীবন মানে উন্নয়ন সবকিছুর মূলে এই পদ্মা সেতু। এই সেতু না হলে আমার ভাগ্যচাকা কবে ঘুরত তা বলা মুশকিল ছিল। পদ্মা সেতুর এক বছর পূর্তিতে যা পেয়েছি তাতে আমার ভাগ্যচিত্র পাল্টে গেছে। আশা করছি আগামী দিনে আরও বেশি লাভবান হতে পারব।

শিবচর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. রাজিবুল ইসলাম বলেন, সবজি রপ্তানিকে আরও সহজ করতে প্যাকেজিং ও প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। তখন কৃষকরা আরও বেশি উৎফুল্ল হয়ে ফসল উৎপাদন করবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক দিপক চন্দ্র হাজরা বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থায় অসাধারণ পরিবর্তন আসায় মাদারীপুর জেলায় কৃষি ফসলের উৎপাদন ও বিক্রি বেড়েছে কয়েকগুণ। পদ্মা সেতুর এক বছরে কৃষিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আগামী দিনে আরও বেশি ফসল উৎপাদন করা হবে।

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মারুফুর রশিদ খান বলেন, পদ্মা সেতু হওয়ার পর মাদারীপুর জেলায় অনেক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কল-কারখানাসহ অসংখ্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এতে করে মাদারীপুরবাসীর নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হওয়ার পর জেলার কৃষি পণ্য ঢাকাসহ সারাদেশে বিক্রির পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। আগামী দিনে জেলার কৃষকরা যেন আরও বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারে সেই লক্ষ্যে কাজ করছে জেলা প্রশাসন।

এদিকে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের বর্ষপূর্তিতে মাদারীপুর জেলা প্রশাসন ২৫ জুন রোববার বিকালে আনন্দ র‌্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান। এ সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সাইফুল ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ঝোটন চন্দ, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাইনউদ্দিনসহ আরও অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *