তাসিনের অন্যরকম গল্প
উচ্চ মাধ্যমিকে আমাদের ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে মারজোরি কিনান রাউলিংসের লেখা ‘অ্যা মাদার ইন ম্যানভিল’ নামে একটি ছোট গল্প ছিল। ১২ বছরের ছোট্ট বালক জেরি এবং একজন লেখিকার গল্প এটি। জেরি এতিম বালক। ক্যারোলিনা মাউন্টেনের চূড়ায় এক এতিমখানায় থাকত সে। কোনো এক শীতে সেখানে প্রচণ্ড তুষারপাত হয়। ঠাণ্ডায় একেবারে জবুথবু অবস্থা। লেখিকার বাসস্থলে একদিন ফায়ার প্লেসের জন্য টুকরো কাঠ পর্যাপ্ত ছিল না। তাই লেখিকা এতিমখানা থেকে একজন ছেলেকে পাঠাতে বলেছিলেন কাঠ কেটে দেয়ার জন্য।
পরদিন বিকেলে জেরি গিয়ে হাজির লেখিকার কক্ষে। জেরি বলল, আমি কাঠ কাটতে এসেছি। জেরির দিকে তাকিয়ে লেখিকা বললেন, আমি তো এতিমখানা থেকে একজন ছেলেকে আসতে বলেছিলাম। জেরি বলল, আমিই সেই। তখন লেখিকা বললেন, তুমি তো অনেক ছোট। কাঠ টুকরো করতে পারবে তো। জেরি প্রতিউত্তরে বলেছিলেন, কাঠ কাটার জন্য শারীরিক গঠন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিছু কিছু বড় ছেলেকে দেখেছি তারা ভালো কাঠ কাটতে পারে না।’….
গল্পটা হয় তো অনেকের জানা। কেন সেটি অবতারণা করলাম এবার সেই প্রসঙ্গে আসি। আমার বাসা থেকে আবাহনী ক্লাবের দূরত্ব খুব বেশি নয়। ফুটবলারদের ক্যাম্প চলাকালীন নিয়মিতই সেখানে যাওয়া হতো। সদ্য শেষ হওয়া হকি খেলোয়াড়দের ক্যাম্পেও অনেকবার যাওয়া হয়েছে। গত বছরের শেষদিকের ঘটনা এটি। আবাহনীর ক্যাম্পে ১৯-২০ বছরের একটি ছেলেকে দেখে আমার কৌতুহল; কে সে? মোটামুটি আবাহনী ক্লাবের খেলোয়াড় তালিকা আমার মুখস্ত। কিন্তু তাকে চিনতে পারছি না। পরিচিত একজনকে জিজ্ঞেস করার পর সে জানাল, ওর নাম আরাফাত হোসেন তাসিন। আমাদের ক্লাবেরই ফুটবলার।
এরপর নিজ থেকেই তার সঙ্গে আলাপ-পরিচয়। প্রথমদিন হায়-হ্যালো। তারপর ধীরে ধীরে সখ্যতা বাড়ল। ফেসবুকের বন্ধু তালিকাতেও স্থান পেল। দীর্ঘ আলাপ পরিচয়ে জানলাম, বাবার অনুপ্রেরণাতেই নাকি ফুটবলে আসা তাসিনের। তার বাবা রফিকুল ইসলাম লিটন জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার। পুরনো ঢাকার গেন্ডারিয়াতে বাড়ি তাদের। এরপর আরো অনেক বিষয়ে কথা হল। তাসিন তার অনেক খেলার ছবি, ভিডিও, পারিবারিক ছবি দেখাল। ছবির অ্যালবাম দেখতে গিয়ে হঠাৎ একটি ছবিতে চোখ আটকে গেল। মাইক হাতে কী যেন বলছেন তাসিন, গায়ে আবাহনীর জার্সি নয়। ভিন্ন এক রঙের, ডিজাইনের জার্সি পরিহিত।
– যাতে লেখা, ‘খেলাধুলায় বাড়ে বল, মাদক ছেড়ে খেলতে চল।’
আমি ধন্ধে পড়ে গেলাম! তাসিনকে জিজ্ঞেস করলাম এসবের মানে কী? তখন সে আমাকে বলল, আমাদের এলাকায় আমি একটি ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছিলাম। টুর্নামেন্টটি আরো কয়েকবার করেছি। সেখানেই মাদকের বিরুদ্ধে এমন স্লোগান সম্বলিত জার্সি পরে খেলোয়াড়রা অংশ নিয়েছিল। শুধু টুর্নামেন্ট আয়োজনই নয় যুব সমাজকে ফুটবলমুখী করতে বিনামূল্যে ফুটবল বিতরণ এবং গেঞ্জিও দিয়েছিলাম। আমি তাকে বললাম, তুুমি এতটুকুন মানুষ; এমন ভাবনা চিন্তা এল কোত্থেকে? সে বলল, আমার বাবাকে দেখেই এসব আমি শেখেছি। তাছাড়া মাদকের ভয়াল দাবা আমাদের যুব সমাজকে, আমাদের বয়সী ছেলে-মেয়েদের ধ্বংস করে দিচ্ছে। খেলাধুলার মাধ্যমে এগুলো আমি রোধ করতে চাই। দেশব্যাপী না পাড়ি, আমার এলাকায় চেষ্টা করতে তো দোষের নয়।
আমি তাকে এও বলেছিলাম, তুমি ছোট মানুষ। এত বড় কাজ একা কী পারবে? উত্তরে তাসিন বলেছিল, ভাই সাইজে ছোট হতে পারি, কিন্তু চিন্তা-ভাবনাতে নয়। আমি একা কোথায়? আমার বাবা আছেন, পরিবারের সদস্যরা আছেন, এলাকাবাসী, আমাদের ক্লাব, আমাদের জাতীয় এবং ক্লাব ফুটবলাররা আছেন ৷আর আশা করি মাদকের বিরুদ্ধে যখন আছি তখন তো পুলিশ -প্রশাসন আমাকে সহযোগিতা করবে ৷ তারা পাশে থাকলে অবশ্যই মাদক শুধু আমার এলাকা থেকে নয় দেশের সমস্ত এলাকা থেকেই এর শেকড় উপরে ফেলা সম্ভব….
জেরি আর তাসিনে কত মিল!