ঈদ রাজনীতি
আন্দোলনের ডাকে বিএনপি, নির্বাচনী প্রচারে আওয়ামী লীগ
১৮ আষাঢ় ১৪৩০ বঙ্গাব্দ,
০২ জুলাই ২০২৩ইং,
দিন বদল ডেক্সঃ
জাতীয় নির্বাচনের আগের শেষ ঈদের সুযোগ নিলেন সংসদীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। বসে ছিলেন না বিরোধী নেতাকর্মীরাও। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও সমমনা বিভিন্ন দলের নেতারা ছিলেন ব্যাপক তৎপর। কে কত বেশি পশু কোরবানি দিয়ে এলাকার মানুষকে খাওয়াতে পারেন, তা নিয়েও চলেছে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। তবে ঈদের আমেজের মধ্যেও বিভিন্ন এলাকায় বাধার মুখে পড়তে হয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতাকর্মীকে। দলের অনেক নেতাকর্মী এলাকাছাড়া অবস্থায়ও ঈদ উদযাপন করেছেন।
নির্বাচনের মাত্র ছয় মাস বাকি থাকার কারণেই এবারের রাজনীতি জমজমাট ছিল। নির্বাচনের আগে শেষ ঈদের সুযোগকে কাজে লাগাতেই বেশ তৎপর ছিলেন রাজনীতিবিদরা। আর এতে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিদেরও ব্যাপক তৎপর দেখা গেছে। এ ছাড়া দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীরা, এমনকি সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতারাও বসে ছিলেন না। সবাই যে যাঁর মতো মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। নিজ নিজ এলাকার দরিদ্র মানুষকে অর্থ ও খাদ্য সহায়তা দিয়েছেন। পশু কোরবানি করে খাইয়েছেন। কেউ কেউ ঈদের দিন মেজবানের আয়োজনও করেছিলেন নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার মানুষের জন্য।
নির্বাচনকেন্দ্রিক গণসংযোগের পাশাপাশি মানুষকে সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতায় ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। বেশিরভাগ স্থানে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করেছেন নেতারা। কেউ কেউ তো রীতিমতো শোডাউনও করেছেন। অন্যদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা যাঁর যাঁর এলাকায় ঈদ পালনের পাশাপাশি আগামী আন্দোলনের প্রস্তুতির নির্দেশনা ও ডাক দিয়েছেন। এলাকায় গণসংযোগেও আন্দোলনের বার্তা পৌঁছে দেন তাঁরা। নির্বাচন নয়, বরং আন্দোলনের বার্তা দিতেই ঈদের মাঠে ছিলেন দলটির মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, এবার নির্বাচনের আগে শেষ ঈদ ছিল। ফলে দলের বর্তমান এমপি ও মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা ঈদকেন্দ্রিক শেষ গণসংযোগের সুযোগ নেবেন– এটাই স্বাভাবিক। এ কারণেই এবার এমপি-নেতাদের ঈদকেন্দ্রিক তৎপরতা বেশি ছিল। এটাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন তাঁরা। কেননা, এটা দেশের মানুষকে নির্বাচনমুখী করে তুলতেও সহায়তা করেছে।
অবশ্য বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, এবারের কোরবানির ঈদে জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষের দিন কেটেছে নিরানন্দে। ক্ষমতাসীনদের বাজার সিন্ডিকেটের কারণে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম যেভাবে হুহু করে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে মধ্যম ও স্বল্প আয়ের মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। দেশের জনগণই যেন আওয়ামী সরকারের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ।
ঢাকা মহানগরে অবস্থানকারী ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের এমপি-নেতাদের এবারের ঈদকেন্দ্রিক সক্রিয়তা যেমন ছিল, তেমনি মন্ত্রী-এমপি-নেতারা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ছুটেও গিয়েছিলেন। ফলে সারাদেশেই এবার জমজমাট ঈদ রাজনীতির ছোঁয়া লেগেছিল। ক্ষমতাসীন দলের বাইরে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির এমপি-নেতারাও কোথাও কোথাও এমন তৎপরতা দেখিয়েছেন। অন্যদিকে, বিএনপির আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে অনিশ্চয়তার থাকার পরও দলটির নেতারা কোথাও কোথাও ঈদকেন্দ্রিক নির্বাচনের রাজনীতিতে তৎপর ছিলেন। জামায়াতের দু-একজন নেতাও এ তৎপরতায় শামিল হন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও ঢাকা-১৩ (মোহাম্মদপুর-আদাবর-শেরেবাংলা নগর) আসনের সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক এবার ছয়টি গরু ও ছয়টি খাসি কোরবানি করে তাঁর নির্বাচনী এলাকার চার হাজার মানুষকে খাইয়েছেন। ঈদে দিনভর নেতাকর্মী ও এলাকার মানুষের সঙ্গে গণসংযোগও করেছেন সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী এবার ১৭টি গরু কোরবানি করে মানুষের মধ্যে মাংস বিতরণ করেছেন। এর মধ্যে ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় আটটি এবং গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার দিলালপুরে ৯টি গরু কোরবানি দিয়ে মানুষকে খাইয়েছেন।
জাতীয় পার্টির প্রধান উপদেষ্টা এবং সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও ময়মনসিংহ-৪ আসনের এমপি রওশন এরশাদ অসুস্থতাজনিত কারণে ঈদ করেছেন ঢাকায়। নিজ বাড়িতে তাঁর পক্ষ থেকে একটি গরু কোরবানি দেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী-৬ আসনের এমপি শাহরিয়ার আলম তাঁর নির্বাচনী এলাকা বাঘা ও চারঘাটে এবার ২৫টি গরু কোরবানি করেছেন। এর মধ্যে আড়ানীর নিজ বাড়িতে একটি, বাঘা উপজেলায় ১৫টি এবং চারঘাট উপজেলায় ৯টি গরু কোরবানি করেছেন। এসব কোরবানির মাংস নেতাকর্মীর মাধ্যমে এলাকার মানুষের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী এবং খুলনা-৩ আসনের এমপি বেগম মন্নুজান সুফিয়ান ঈদ সামনে রেখে ৯ দিনের সফরে খুলনা নগরীর রেলগেট এলাকার বাড়িতে ছিলেন। নিজ বাড়িতে একটি গরু কোরবানির পাশাপাশি নেতাকর্মীর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী ও ময়মনসিংহ-২ আসনের এমপি শরীফ আহমেদ তাঁর নির্বাচনী এলাকা ফুলপুর ও তারাকান্দা এলাকায় সাতটি গরু কোরবানি দিয়ে এলাকার মানুষকে খাইয়েছেন। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী ও ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) আসনের এমপি কে এম খালিদ নিজ দলের নেতাকর্মীর সঙ্গে এলাকায় ঈদ উদযাপন করেছেন।
ঢাকা-৫ আসনের সরকারদলীয় এমপি কাজী মনিরুল ইসলাম মনু একাই ১২টি গরু কোরবানি দিয়ে ২০০০ মানুষের মধ্যে মাংস বিতরণ করেছেন। একইভাবে স্বেচ্ছাসেবক লীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ও আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী কামরুল হাসান রিপন ১২টি গরু কোরবানি দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে তিনিও এলাকার মানুষের মধ্যে কোরবানির মাংস বিতরণ করেছেন। নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক এমপি ও সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ হাসনাত আল কায়সার নিজ এলাকায় কোরবানি করে দেড় হাজার মানুষকে খাইয়েছেন। কিশোরগঞ্জ-২ আসনের আওয়ামী লীগের এমপি নুর মোহাম্মদ কোরবানি করে ছয়শ মানুষকে খাইয়েছেন।
এদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম বগুড়ায় তাঁর নিজ বাড়িতে একটি গরু ও একটি ছাগল কোরবানি দিয়েছেন। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটু ২০টি গরু কোরবানি দিয়ে এলাকার বিপুলসংখ্যক মানুষকে খাইয়েছেন।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, রংপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, বগুড়া, নেত্রকোনা, সিরাজগঞ্জসহ দেশের অন্যান্য এলাকায়ও একই চিত্র দেখা গেছে। চট্টগ্রামে ঈদ সামনে রেখে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় কোরবানি দেওয়ার পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী গরুর মাংস ও সাদা ভাত দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করান।
জমজমাট ঈদ রাজনীতির মধ্যেও স্বস্তিতে ছিলেন না বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা। বিএনপির কয়েকজন নেতা বলেছেন, কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় নিজেদের সাধ্যমতো সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি নির্যাতিত নেতাকর্মীর খোঁজ নেওয়ার কঠোর নির্দেশনায় ত্যাগীদের নিয়ে ঈদ উদযাপন করেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। এলাকায় বিভিন্ন সময়ে যেসব নেতাকর্মী নির্যাতিত হয়েছেন, গুম-খুন হয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন কিংবা কারাগারে রয়েছেন–সেসব পরিবারের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে, যা কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করা হয়। এ ছাড়া দলকে আরও সংগঠিত করতে, তাদের চলমান আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে জনমত গঠনেও কাজ করেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এক দফা আন্দোলনের কর্মসূচি সামনে রেখে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
দলটির নেতারা জানান, ঈদের আগে কুমিল্লার লাকসামে ছাত্রলীগের একজন নেতা নিহতের ঘটনায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত এলাকাছাড়া ছিলেন। পুলিশের মামলা, গ্রেপ্তার ও ক্ষমতাসীন দলের হামলার ভয়ে তাঁরা ঘরছাড়া হয়েছেন বলে অভিযোগ নেতাকর্মীর। অন্যদিকে বরিশালের গৌরনদী-আগৈলঝাড়া এলাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ও দলের মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহিরউদ্দিন স্বপনের এলাকায় আগমন উপলক্ষে ক্ষমতাসীন দলের মহড়ায় উত্তেজনা বিরাজ করে। তবে শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে তিনি এলাকায় প্রবেশ করতে পারেন এবং নেতাকর্মীকে নিয়ে ঈদ উদযাপন করেন।
এদিকে নির্যাতিত নেতাকর্মীর মধ্যে ভোলায় পুলিশের গুলিতে নিহত জেলা ছাত্রদলের সভাপতি নুরে আলমের পরিবারের ঈদ উদযাপনে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এর বাইরে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তাঁদের ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমানসহ ২৮ নেতাকর্মীর নামে চারটি গরু কোরবানি দিয়েছে কেন্দ্রীয় বিএনপি। রাজধানীর গুলশানের কার্যালয়ে এই কোরবানি দেওয়া হয়, যার ব্যবস্থাপনায় ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। প্রতিটি গরুতে সাতজন অংশীদার রাখা হয়। দেশের কয়েকটি স্থানে স্থানীয়ভাবেও পশু কোরবানি ছাড়াও নিহত নেতাকর্মীর পরিবারসহ আহত ও নির্যাতিত নেতাকর্মীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।
(তথ্য-উপাত্তে বিভিন্ন জেলা প্রতিনিধিরা)