স্বাধীন পরাধীন নারী ও কিছু কথা
বরাবরই স্বাধীনতার সজ্ঞা আমার কাছে একটু আলাদা, আর নারী স্বাধীনতা তো অবশ্যই প্রচলিত স্বাধীনতার সজ্ঞার চেয়ে আলাদা! আমার মতে নারী স্বাধীনতা শুধু ইচ্ছামত বাইরে চলাফেরা বা চাকুরী ব্যাবসা করা নয়! অনেক নারী আছেন স্বামী/শশুড়বাড়ী নিয়ম শৃ্ঙ্খলা থেকে নিজেকে মুক্ত করেই নিজেকে স্বাধীন ভেবে নিজের চেতনার অজান্তে জড়িয়ে পড়ছেন কঠিন পরাধীনতার শৃঙ্খলে। চাকুরী বা ব্যাবসা ক্ষেত্রে কথিত স্বাধীন নারীগন এর অধিকাংশই আমার মতে মোটেও স্বাধীন নন! উর্ধতন কর্তৃপক্ষের বা সহকর্মীর ইচ্ছা অনিচ্ছার সাথে আপোষ করেই চলতে হয় নিজেকে, নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা বাস্তবায়নের কতটুকু স্বাধীনতা আছে সেখানে! তেমনি ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও! অবশ্য এই সব স্থানে পুরুষরাও এক অর্থে অন্যের অধীন, অর্থাৎ পরাধীন!
আমি মনে করি-
সুস্থ্য সমাজ ব্যাবস্থা অব্যাহত রাখতে বা সভ্যতার চর্চা গতিময় রাখতে জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই অন্যের অধিনস্ততা মেনে নিতে হয় বৈকী! যদি তা ইতিবাচক হয়! আর পরিবার তথা সংসার নিশ্চয় সমাজ বহির্ভূত নয়! আর পরিবারের ও কিছু ইতিবাচক নিয়ম শৃঙ্খলা আছে যা মেনে চলার নাম পরাধীনতা নয়! নিজ স্বামী বা শশুড়বাড়ি কিংবা বাবা ভাই বা অন্য কোনো অভিভাবকের অধীনের চেয়ে অবশ্যই এমন অধিকার কে স্বাধীনতা আমি অন্তত বলিনা যেখানে – ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো পুরুষের সাথে করমর্দন করতে হয়, বস্ এর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রতিদিন নিজের মুখে মেকাপ এর প্রলেপ লেপন করতে হয়, চোখের সামনে অনৈতিক ঘটনা ঘটতে দেখেও নিজে অন্ধের মত থাকতে হয়। ভালো লাগা মন্দ লাগাবোধকে অতিক্রান্ত করে অফিস কিংবা ব্যাবসা কেন্দ্রে আপাদমস্তক নিজেকে উপস্থিত করতে হয়। বাইরের শত শত লোলুপ দৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে প্রতিমুহূর্তে উলটো পথে চলতে হয়, কিংবা রিক্সার হূড় তুলে নিজেকে আড়াল করে রাখতে হয়।
কতটা স্বাধীন আমাদের বাংলাদেশের নারীরা তা খতিয়ে দেখার কোনো চোখ আমার গোচরে পড়েনা! বরং পরাধীন ও নির্যাতিতা নারী খোঁজার মত ব্যাক্তি বা সংগঠনের অভাব নেই,যদিও স্বাধীনতার অর্থ ভুল ভাবে বহন করে চলেছে তাদের অনেকে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই নারীরা জন্মগত ভাবেই এমন কিছু দায় দায়িত্বের অধীনস্ত যা আমাদের বাংলাদেশে এখনো কথিত স্বাধীনতাকামীরা প্রচলন করতে পারেনি। আমাদের দেশের নারীদের সন্তান প্রসব করার মত গর্বিত প্রাকৃতিক দায়িত্বের সাথে সন্তান লালন পালন ও শিক্ষা ব্যাবস্থার যোগানের দায়ের অধীনস্ত হতে হয়না। অর্থনৈতিক দায়িত্বের মত কঠিন দায়িত্বের শৃঙ্খলে পুরুষরাই আবদ্ধ! এখনো স্ত্রীকে পূর্ণাঙ্গ ভরণ পোষন না করতে পারাটা আমাদের দেশের পুরুষের কাছে চরম লজ্জার! যা অনেক দেশের পুরুষদেরই নয়!
আমাদের দেশের নারীদের একটি বিরাট অংশ এখনো অর্থনৈতিক ভাবে স্বামী, বাবা, ভাইয়ের উপর নির্ভরর্শীল, তার মানে এই নয় যে তারা পরাধীন! কিছু সংখ্যক যে একেবারেই পরাধীন নয় তাও বলবো না! পরাধীন নারী অবশ্যই আছেন! তবে গয়রাহ যেভাবে নারীদের পরাধীন বলা হয় মোটেও তেমন নয়! কেবল রান্না বান্না, সন্তান লালন পালন করা যে নারীরা নিজেদের কে পরাধীন ভেবে চাকুরী করা ব্যাবসা করা নারীদের দেখে আফসোস করে বা ঈর্ষান্বিত হয় তাদেরকে অধিক ভাগ্যপ্রসন্ন মানুষ বলেই আমি মনে করি। নিজের শিক্ষাকে সবসময়ই যে অর্থনৈতিক কাজেই ব্যাবহার করতে হবে তা আমি মনে করিনা, সংসারে শিক্ষার ব্যবহার উপার্জন ছাড়া ও সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অনেক ভালো আছেন আমাদের দেশের ঘরে বসে স্বামী সন্তানের পরিচর্যা করা নারীরা, তারাও দেশ ও সমাজের উন্নয়নেই কাজ করছেন!
একজন আদর্শ গৃহিনীর উপর অনেকাংশেই নির্ভর করে একজন সন্তান এর আদর্শ নাগরীক হিসাবে গড়ে ওঠা। আর একজন আদর্শ নাগরীক দেশ ও জাতির সম্পদ! যদি একজন নারী মুক্তিযোদ্ধাকে সেবা শুশ্রূষা করে রান্না করে খাইয়ে সমমর্যাদার মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেন তবে সব নারীরাই স্বামী সন্তান সহ নিজ সংসারের পরিচর্যা করে পুরুষের সমান সমাজ ও দেশের উন্নয়নের অংশীদারী নাগরীক সন্মান পেতে পারেন! সংসার পরিচালনা করাও কম দক্ষতার কাজ নয় যে তা ছোটো করে দেখবো! বাইরে কাজ করাটাও এতটা স্বাধীনতার নয় যে আমরা পুরুষকে সর্বক্ষেত্রে স্বাধীন মনে করবো।
কর্মজীবি নারীদের মুখের কথায় স্বাধীনতার অনেক গর্বিত বক্তব্য থাকলেও তাদের অন্তরে কান পেতে কে কবে শোনার চেষ্টা করেছে যে তাদের কতটা পরাধীনতার শ্বাসনে থাকতে হয়? অনেক ভালো না লাগা মুহূর্তেও হাসির প্রলেপ ঠোঁটে লাগিয়ে রাখতে বাধ্য! বাড়িয়ে দেওয়া পুরুষের হাতে হাত মেলাতে অস্বস্তি হলেও বাধ্য! শারীরিক অসুবিধা অস্বস্তিতেও অফিসে উপস্থিত হতে বাধ্য।
বাংলাদেশে ব্যাবসা ও চাকুরীতে তৃণমূল হতে সফলতার শীর্ষস্থানীয় নারীদের অন্তরে লেখা থাকে কতটা সংগ্রাম করলে কতটা ক্লান্তি! আর কতটা ক্লান্তিতে স্বাধীন নারীর উপাধি পেয়েছে! আর সত্যিকার অর্থেই স্বাধীনতা কতটা হারিয়ে বন্দি হয়েছেন পরাধীনতার নাগ পাশে! তাদের উপার্জন করতে হয়, তারা উপার্জন করে বলে দুপুরে খাওয়ার পরে আরাম করে ঘন্টা খানেক ঘুমাতে পারেনা, তারা উপার্জন করতে বাধ্য বলে ভোরের হিমেল আমেজের স্বাদ নিতে কম্বল কিংবা লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকার স্বাদ পায়না! তাদের উপার্জন করতে হয় বলেই ইচ্ছে হলেই স্বামী সন্তানের হাত ধরে বাচ্চার দির্ঘ স্কুল ছুটিতেও কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়না! ওরা দায় দায়িত্বের কঠিন শৃঙখলে বন্দি! ক্লান্তি অবস্বাদে ওদের ইচ্ছে করে সমস্ত দায়িত্ব কারো কাধে চাপিয়ে একটু আরামে সময় কাটাতে! ওরাই পরাধীন স্বাধীন মোড়কের অভ্যান্তরে!
নিলীমা সরকারের ফেইসবুক থেকে নেওয়া।